আহমদ হোসেন খান : তাঁর নিপুণ রম্যশৈলী
সমাজের শুদ্ধি ও সংস্কারে যুগে যুগে শুদ্ধ মানুষেরা অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। সমাজের অসুখ-বিসুখ ও অসংগতি চিহ্নিত করে তার সুচিকিৎসায় অবদান রেখেছেন এসব কীর্তিমান মনীষী। কবি, সাহিত্যিকগণ সেই অর্থে সমাজ-সংস্কারক ও মানবতার শক্তিমান বন্ধু। জাতির মেধাবী এ সন্তানেরা তাদের মেধা ও প্রতিভাকে জাতির সেবায় নিবেদন করেছেন। জাতীয় উন্নতির পেছনে তাদের কার্যকর ও নিরলস শ্রমসাধনাকে ভুলে থাকার সুযোগ নেই। রম্য বা রসরচনা সাহিত্যের একটি উর্বর শাখা। আরবি ভাষায় একটি কথা আছে, সরল কথার চাইতে ইঙ্গিতের ধার অনেক বেশি। রম্য রচনায় সাহিত্যিক তার বক্তব্য বিষয়টি সোজাসাপ্টা ও সাদামাটা ভাষায় নয় রসাত্মক খোঁচার ঢঙে অভিব্যক্ত করেন। রম্য সাহিত্যিকের রসবোধ তার লেখার মধ্যদিয়ে পাঠকের অন্তর্প্রদেশে স্থানান্তরিত হয়। তার মনোজগতে সঞ্চার করে ব্যতিক্রমী প্রতিক্রিয়া। মিষ্টান্ন আপনার রসনায় মধুময় অনুভুতি জাগাতে পারে কিন্তু ঝালের কাজ একেবারেই ভিন্ন। সেই ভিন্ন স্বাদ আর অন্যরকম অনুভুতি পাঠকের মাঝে পাঠতৃষ্ণা জাগানোর পাশাপাশি প্রজন্মের অধ্যয়নবিমুখ অংশকে বুদ্ধিবৃত্তিক শুদ্ধতা চর্চার সবুজ অঙ্গণে ফিরিয়ে আনতে পারে। সমাজের পচন ঠেকাতে এর প্রয়োজনীয়তা অবিসংবাদিত ও প্রশ্নাতীত।
চট্টগ্রামের অন্যতম পাঠকপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে ইবনে সাজ্জাদ ছদ্মনামে প্রায় একযুগ ধরে লিখে যাওয়া অধ্যক্ষ আহমদ হোসেন -এর ‘বিরস রচনা’ পাঠকের অনুভুতিতে তীব্র, তীক্ষœ ও অন্তর্ভেদী এক আলোড়ন তুলেছিল। তিনি চমৎকার রম্য নৈপূণ্যে প্রতিটি রস-রচনার পরতে পরতে অসামান্য ‘রসায়ন’ ঘটিয়েছেন। তাঁর বেশিরভাগ প্রবন্ধের সূচনা কোনও না কোনও প্রাসঙ্গিক ঘটনা, লোককাহিনী কিংবা কৌতুুকপ্রদ গল্প দিয়ে। তিনি যেন অতীতের আয়নায় বর্তমানকে মুন্সিয়ার সঙ্গে উদ্ভাসিত করেছেন আর বাস্তবতার প্রতি অঙুলি নির্দেশ করে পাঠকের নুয়েপড়া চেতনাকে আন্দোলিত ও সচকিত করেন। রম্য লেখার পারঙ্গমতা প্রত্যেক লেখক-সাহিত্যিকের থাকে না; কারও কারও থাকে। তিনি সেসব কীর্তিমানদের অন্যতম- রস রচনায় যাদের পদচারণা স্বতঃস্ফূর্ত, গতি অনায়াস, স্বচ্ছন্দ ও রীতিমতো দুর্দান্ত।
এমন একজন জাত-সাহিত্যিকের রম্য প্রবন্ধ ও সাহিত্যকর্মের ওপর মূল্যায়নধর্মী লেখার হিম্মৎ অন্তত আমার জন্য কিছুটা স্পর্ধারই শামিল। দৈনিক পূর্বদেশের সহকারী সম্পাদক সুসাহিত্যিক কাজী সাইফুল হকের অনুরোধে এ বিষয়ে কয়েক ছত্র লিখতে বসা। লেখকের রম্য রচনাগুলোর নতুনপাঠ চিন্তার জগতকে আলোড়িত ও আলোকিত করার সুযোগ এনে দিয়েছে-এটা আমার জন্য একটি মূল্যবান প্রাপ্তি।
কীর্তিমান রম্য সাহিত্যিক আহমদ হোসেন ছদ্মনামে ইবনে সাজ্জাদ সমাজজীবনের গভীরে ডুব দিয়ে আমাদের নেতিবাচক প্রবণতাগুলোর গোড়ায় খোঁচা দিয়েছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। ভূতের তৈল বাহির করিল কে ? শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি লিখেনÑ‘ভূতের বিরুদ্ধে লড়িবার ‘পুত’গণ হারাইয়া গিয়াছে। বাংলা পুতগণ চাঁদাবাজ, মন্তান, ধান্দাবাজ ইত্যাদি নামের ভূতে পরিণত হইয়াছে।’ মুসলিম দুনিয়ার মানুষদের মধ্যে জাগরণ নাই- তাহারা বিলাপের মধু খাইয়া এখন কদু বনিয়া গিয়াছে। ফিলিস্তিনীদের একটি প্রচারপত্রে লেখা ছিল- ‘‘পাখির বাসা আছে, শেয়ালের গর্ত আছে আমরা ফিলিস্তিনীদের কোন নিবাস নাই।’’ তাহাদের আবাসভূমি কাড়িয়া নেওয়া হইয়াছিল। এই লড়াইয়ের বিপক্ষশক্তি ইসরাইল নহে ইহার বিপক্ষে শান্তির বড় শত্রু হইল মার্কিন সাম্রারাজ্যবাদ, তাহাদের বিরুদ্ধে কেহ কিছু কহিলে তাহারা হইবেন সন্ত্রাসী আর মার্কিন মদদে যাহারা মানুষ হত্যা করিবে তাহারা হইবেন সন্যাসী।’
উদ্ধৃত লেখায় আমরা আধিপত্যবাদী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানবতার পক্ষে এক নিরাপস আহমদ হোসেনকে দেখতে চাই। তার কলমকে চাবুক হয়ে আঘাত হানতে দেখি দখলদার সাম্রাজ্যবাদীরা জানোয়াদের ঘাড়ে।
আবার কখনও দেখি আমাদের সমাজের নৈতিক দুরবস্থার প্রতি তিনি রসাত্মক তীর ছুঁড়ে দিয়েছেন সুবচন নির্বাসন প্রভৃতি শিরোনাম চয়ন করার শৈল্পিক কায়দায়। ফ্রি প্যাকেজ বোকা টকাইবার টিকেট শিরোনামে তিনি বাঙালির হুজুগে স্বভাবকে শোধরানোর জন্যে হাজির করেছেন গোপাল ভাঁড়কে। লিখেছেন : ‘একদা গোপাল ভাঁড় হাটে গমন করিল। জনৈক বেগুন বেপারীকে কহিল, ওহে একসের বেগুন ওজন কর। বেগুন বেপারী মনের আনন্দে বেগুন মাপিল। বেগুন মাপা শেষ হইলে গোপাল ভাঁড় পুনরায় কহিল : তুমি কি দুই একটি বেগুন ফ্রি দাওনা ?
: নিশ্চয় নিশ্চয়।
: অতএব আমি দুইটি ফ্রি বেগুনই লইয়া গেলাম।
গোপাল ভাঁড়ের হাতে নতুন জাতের কচি বেগুন দেখিয়া তাহার স্ত্রী নাকের নোলক দোলাইয়া সহাস্য বদনে কহিল : চমৎকার ! চমৎকার! আপনি মম হৃদয়ের বাসনা কেমনে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন ?
: তোমার হৃদয়ের বাসনা কী ছিল ?
: আমার হৃদয়ের বাসনা ছিল নতুন বেগুনের ভর্তা খাইব, তুমি আমার মনে কথা কেমনে বুঝিতে পারিলে ? আচ্ছা বেগুনের সের কত ?
: ফ্রি
: ফ্রি !
: হ্যাঁ ফ্রি !! ...
বর্তমানে ক্রেতার মনোবাসনা পূরণ ও উৎপাদিত সামগ্রী জনপ্রিয় করিবার উদ্দেশ্যে ‘ফ্রি’ নামক অদ্ভূত কৌশল প্রয়োগ করিতেছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য, দেশি-বিদেশি পণ্য ‘ফ্রি- ফ্রি’ ধন্য হইয়া উঠিয়াছে, নিন্দুকগণ কহিতেছে তাহা একপ্রকার ‘ফ্রি ভাইরাস’। অতীতে বিশেষ করিয়া বিদেশিরা ‘ফ্রি’ নামক টোপ দিয়া আমাদিগকে মুক্ত করিয়া অবশেষে জালে আবদ্ধ করিয়াছে।’...কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ইবনে সাজ্জাদ আরও লিখেছেন- পরীক্ষার হলে নকল ফ্রি, অফিস-আদালতে ঘুষ ফ্রি। ফ্রি স্টাইলে হাইজ্যাক, খুন, আসামী পলায়ন, নারী ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, শিশু নির্যাতন (গুম আর ক্রসফায়ার কেন বাদ পড়লো কী জানি !), খাদ্যে ভেজাল মিশানো সর্বত্র আজ ফ্রি’র উৎসব।
অধ্যক্ষ আহমদ হোসেন এর প্রতিটি লেখার শিরোনাম আপনাকে জানান দেবে বিরস রচনায় তিনি কতটা সিদ্ধহস্ত। কাঙালের বাসি কথা নামে বলাকা, মোমিন রোড, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত তার রম্য রচনা সংকলন গ্রন্থটির শিরোনামে একবার চোখ বুলালে আপনি তার রম্য রসের স্বাদে আটকা পড়তেই পারেন।
► বোগদাদী ছাই
► পন্ডিতত্রয়ের তালতত্ত্ব
► কর্মময় দিন নিদ্রাময় রাত্রি কবে আসিবে ?
► মি. এডিস ইন বাংলাদেশ
► হরতালের বীমা
► সুবচন নির্বাসন
► ভদ্র ও অভদ্র
►গরিবের মরিয়া মরিয়া বাঁচিয়া থাকা
► গরু মারিয়া জুতাদান
► ছাগল নাচে খুঁটির জোরে
► ঝিকে মারিয়া বউকে শিখান
► বাঙালির তিন হাত
► খালি পেটে গালি দাও প্রভৃতি।
তিনি নিজের রচনায় একাধারে ঘটনা বা রূপকথার প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি চয়নে দক্ষতা, উপস্থাপনার পারদর্শিতা, বাক্য বুননের মুন্সিয়ানা এবং পাঠককে বয়ান-রসের বিপুল আকর্ষণে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
কায়েমী স্বার্থের কাছে মাথা নোয়ানো সুবিধাবাদী ‘বুদ্ধিজীবি’দের চরিত্র চিত্রণ করতে গিয়ে তিনি গোপাল ভাঁড়কে উদ্ধৃত করেছেন এভাবে-
রাজা : আর কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে ?
গোপাল ভাঁড় : তোষামোদ মন্ত্রণালয় স্থাপন করিতে হইবে। আমাকে সে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিয়োগ করিতে হইবে। এই মন্ত্রণালয় দেশের বুদ্ধিজীবীদের ক্রয় করিয়া লইবে। শিক্ষিত লোককে যত সহজে সহজে ক্রয় করা যায় নিরক্ষর লোককে, শ্রমজীবীদেরকে তত সহজে ক্রয় করা সম্ভব নহে।
রাজা : তাহারা কী করিবে ?
গোপাল ভাঁড় : ভাল বেশ ! বেশ ! তত্ত্ব প্রচার করিবে। তার চয়িত কথাগুলোর ভেতর দিয়ে আমরা আজকের সমাজের তোষামোদ ব্যাধির স্বরূপ উন্মোচিত হতে দেখি। আজকাল আর তোষামোদের মতো দরকারি ‘পবিত্র কর্ম’ সম্পাদনের জন্য একটি মন্ত্রণালয় বড়ই অপ্রতুল হয়ে যায়; তাই অধিকাংশ মন্ত্রণালয়কে সেই গুরুত্ব দায়িত্ব যতেœর সহিত পালন করতে দেখা যায়।
সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে পলায়নরত শান্তির শ্বেত পায়রার উড়াল দেখে লেখকের হৃদয় কেঁদে উঠে বলেই হয়তো তিনি এভাবে- মনের আক্ষেপ ঝেড়েছেন-‘ফুটবলের মতো রসগোল্লা আর গরুর গাড়ির চাকার মতো জিলাপী খাইবার আশা নাই। উন্নয়নের জোয়ারে আর অবগাহনের স্বপ্ন নাই। আমরা শান্তি চাই, কর্ম
কর্মময় দিন আর নিদ্রাময় রাত্রি চাই।’
অধ্যক্ষ আহমদ হোসেন সমাজকে খুব কাছ থেকে অবলোকন, পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করেছেন। তৃণমূল মানুষের সুখ-দুখ, হাসি-কান্না ও জীবনসমস্যার তীর্যক বিশ্লেষণ করেছেন। ঘূণেধরা সমাজের কতিপয় রীতি-রেওয়াজ ও প্রথা পালনের আড়ালে প্রান্তিক মানুষ ও দরিদ্র শ্রেণীর জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলার কথা এবং সমাজসৃষ্ট কিছু অকথিত কষ্ট আর দুর্দশার বয়ান তার শাণিত লেখনীতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি গরু মারিয়া জুতাদান শিরোনামের প্রবন্ধে লিখেছেন :
রবিন্দ্রনাথ যদি এই যুগে বাঁচিয়া থাকিতেন তবে তাহার রচিত কাবুলিওয়ালা গল্পটা রচনা করিতেন কিনা সন্দেহ। কাবুলিওয়ালা গল্পে মিনির বাবা কন্যার বিবাহের ‘আলোকসজ্জার’ সমস্ত টাকা রহমতকে দিয়াছিল দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য। মিনির বাবা মনে করিয়াছিল ইহাতেই তাহার কন্যার কল্যাণ হইবে। না, এখন জৌলুস দেখাইতে পারিলেই যেন কল্যাণ ও শুভ হুমড়ি খাইয়া জামাই কন্যার বুকে পড়িবে।...এখনও এই দেশে মানুষ এক বেলাই খাইয়া জীবন ধারণ করে। ফুটপাতে নর্দমার পাশে মানবেতর জীবন যাপন করে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে। সেই দেশে বিবাহের এই বিলাসিতা গরীব মানুষের প্রতি উপহাস ছাড়া আর কিছুই নহে।
------------------------------------------------------------------------------------------
খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
খুলশী, চট্টগ্রাম। ২৯.১০.২০১৫ বৃহস্পতিবার।
kmhamidullah@gmail.com
0177 9865882