নোটিশ
আপনি কি ব্লগ কিংবা ফেসবুকে ইসলাম এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতে আগ্রহী?
তাহলে আপনার লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের ফেসবুক পেজে মেসেজ দিন। ধন্যবাদ

Tuesday, November 28, 2017

আহমদ হোসেন খান : তাঁর নিপুণ রম্যশৈলী


আহমদ হোসেন খান : তাঁর নিপুণ রম্যশৈলী

সমাজের শুদ্ধি ও সংস্কারে যুগে যুগে শুদ্ধ মানুষেরা অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। সমাজের অসুখ-বিসুখ ও অসংগতি চিহ্নিত করে তার সুচিকিৎসায় অবদান রেখেছেন এসব কীর্তিমান মনীষী। কবি, সাহিত্যিকগণ সেই অর্থে সমাজ-সংস্কারক ও মানবতার শক্তিমান বন্ধু। জাতির মেধাবী এ সন্তানেরা তাদের মেধা ও প্রতিভাকে জাতির সেবায় নিবেদন করেছেন। জাতীয় উন্নতির পেছনে তাদের কার্যকর ও নিরলস শ্রমসাধনাকে ভুলে থাকার সুযোগ নেই। রম্য বা রসরচনা সাহিত্যের একটি উর্বর শাখা। আরবি ভাষায় একটি কথা আছে, সরল কথার চাইতে ইঙ্গিতের ধার অনেক বেশি। রম্য রচনায় সাহিত্যিক তার বক্তব্য বিষয়টি সোজাসাপ্টা ও সাদামাটা ভাষায় নয় রসাত্মক খোঁচার ঢঙে অভিব্যক্ত করেন। রম্য সাহিত্যিকের রসবোধ তার লেখার মধ্যদিয়ে পাঠকের অন্তর্প্রদেশে স্থানান্তরিত হয়। তার মনোজগতে সঞ্চার করে ব্যতিক্রমী প্রতিক্রিয়া। মিষ্টান্ন আপনার রসনায় মধুময় অনুভুতি জাগাতে পারে কিন্তু ঝালের কাজ একেবারেই ভিন্ন। সেই ভিন্ন স্বাদ আর অন্যরকম অনুভুতি পাঠকের মাঝে পাঠতৃষ্ণা জাগানোর পাশাপাশি প্রজন্মের অধ্যয়নবিমুখ অংশকে বুদ্ধিবৃত্তিক শুদ্ধতা চর্চার সবুজ অঙ্গণে ফিরিয়ে আনতে পারে। সমাজের পচন ঠেকাতে এর প্রয়োজনীয়তা অবিসংবাদিত ও প্রশ্নাতীত।

চট্টগ্রামের অন্যতম পাঠকপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে ইবনে সাজ্জাদ ছদ্মনামে প্রায় একযুগ ধরে লিখে যাওয়া অধ্যক্ষ আহমদ হোসেন -এর ‘বিরস রচনা’ পাঠকের অনুভুতিতে তীব্র, তীক্ষœ ও অন্তর্ভেদী এক আলোড়ন তুলেছিল। তিনি চমৎকার রম্য নৈপূণ্যে প্রতিটি রস-রচনার পরতে পরতে অসামান্য ‘রসায়ন’ ঘটিয়েছেন। তাঁর বেশিরভাগ প্রবন্ধের সূচনা কোনও না কোনও প্রাসঙ্গিক ঘটনা, লোককাহিনী কিংবা কৌতুুকপ্রদ গল্প দিয়ে। তিনি যেন অতীতের আয়নায় বর্তমানকে মুন্সিয়ার সঙ্গে উদ্ভাসিত করেছেন আর বাস্তবতার প্রতি অঙুলি নির্দেশ করে পাঠকের নুয়েপড়া চেতনাকে আন্দোলিত ও সচকিত করেন। রম্য লেখার পারঙ্গমতা প্রত্যেক লেখক-সাহিত্যিকের থাকে না; কারও কারও থাকে। তিনি সেসব কীর্তিমানদের অন্যতম- রস রচনায় যাদের পদচারণা স্বতঃস্ফূর্ত, গতি অনায়াস, স্বচ্ছন্দ ও রীতিমতো দুর্দান্ত।
এমন একজন জাত-সাহিত্যিকের রম্য প্রবন্ধ ও সাহিত্যকর্মের ওপর মূল্যায়নধর্মী লেখার হিম্মৎ অন্তত আমার জন্য কিছুটা স্পর্ধারই শামিল। দৈনিক পূর্বদেশের সহকারী সম্পাদক সুসাহিত্যিক কাজী সাইফুল হকের অনুরোধে এ বিষয়ে কয়েক ছত্র লিখতে বসা। লেখকের রম্য রচনাগুলোর নতুনপাঠ চিন্তার জগতকে আলোড়িত ও আলোকিত করার সুযোগ এনে দিয়েছে-এটা আমার জন্য একটি মূল্যবান প্রাপ্তি। 

কীর্তিমান রম্য সাহিত্যিক আহমদ হোসেন ছদ্মনামে ইবনে সাজ্জাদ সমাজজীবনের গভীরে ডুব দিয়ে আমাদের নেতিবাচক প্রবণতাগুলোর গোড়ায় খোঁচা দিয়েছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। ভূতের তৈল বাহির করিল কে ? শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি লিখেনÑ‘ভূতের বিরুদ্ধে লড়িবার ‘পুত’গণ হারাইয়া গিয়াছে। বাংলা পুতগণ চাঁদাবাজ, মন্তান, ধান্দাবাজ ইত্যাদি নামের ভূতে পরিণত হইয়াছে।’ মুসলিম দুনিয়ার মানুষদের মধ্যে জাগরণ  নাই- তাহারা বিলাপের মধু খাইয়া এখন কদু বনিয়া গিয়াছে। ফিলিস্তিনীদের একটি প্রচারপত্রে লেখা ছিল- ‘‘পাখির বাসা আছে, শেয়ালের গর্ত আছে আমরা ফিলিস্তিনীদের কোন নিবাস নাই।’’ তাহাদের আবাসভূমি কাড়িয়া নেওয়া হইয়াছিল। এই লড়াইয়ের বিপক্ষশক্তি ইসরাইল নহে ইহার বিপক্ষে শান্তির বড় শত্রু হইল মার্কিন সাম্রারাজ্যবাদ, তাহাদের বিরুদ্ধে কেহ কিছু কহিলে তাহারা হইবেন সন্ত্রাসী আর মার্কিন মদদে যাহারা মানুষ হত্যা করিবে তাহারা হইবেন সন্যাসী।’
উদ্ধৃত লেখায় আমরা আধিপত্যবাদী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানবতার পক্ষে এক নিরাপস আহমদ হোসেনকে দেখতে চাই। তার কলমকে চাবুক হয়ে আঘাত হানতে দেখি দখলদার সাম্রাজ্যবাদীরা জানোয়াদের ঘাড়ে। 
আবার কখনও দেখি আমাদের সমাজের নৈতিক দুরবস্থার প্রতি তিনি রসাত্মক তীর ছুঁড়ে দিয়েছেন সুবচন নির্বাসন প্রভৃতি শিরোনাম চয়ন করার শৈল্পিক কায়দায়। ফ্রি প্যাকেজ বোকা টকাইবার টিকেট শিরোনামে তিনি বাঙালির হুজুগে স্বভাবকে শোধরানোর জন্যে হাজির করেছেন গোপাল ভাঁড়কে। লিখেছেন : ‘একদা গোপাল ভাঁড় হাটে গমন করিল। জনৈক বেগুন বেপারীকে কহিল, ওহে একসের বেগুন ওজন কর। বেগুন বেপারী মনের আনন্দে বেগুন মাপিল। বেগুন মাপা শেষ হইলে গোপাল ভাঁড় পুনরায় কহিল : তুমি কি দুই একটি বেগুন ফ্রি দাওনা ? 
: নিশ্চয় নিশ্চয়। 
: অতএব আমি দুইটি ফ্রি বেগুনই লইয়া গেলাম।
গোপাল ভাঁড়ের হাতে নতুন জাতের কচি বেগুন দেখিয়া তাহার স্ত্রী নাকের নোলক দোলাইয়া সহাস্য বদনে কহিল : চমৎকার ! চমৎকার! আপনি মম হৃদয়ের বাসনা কেমনে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন ? 
: তোমার হৃদয়ের বাসনা কী ছিল ? 
: আমার হৃদয়ের বাসনা ছিল নতুন বেগুনের ভর্তা খাইব, তুমি আমার মনে কথা কেমনে বুঝিতে পারিলে ? আচ্ছা বেগুনের সের কত ? 
: ফ্রি 
: ফ্রি !
: হ্যাঁ ফ্রি !! ...
বর্তমানে ক্রেতার মনোবাসনা পূরণ ও উৎপাদিত সামগ্রী জনপ্রিয় করিবার উদ্দেশ্যে ‘ফ্রি’ নামক অদ্ভূত কৌশল প্রয়োগ করিতেছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য, দেশি-বিদেশি পণ্য ‘ফ্রি- ফ্রি’ ধন্য হইয়া উঠিয়াছে, নিন্দুকগণ কহিতেছে তাহা একপ্রকার ‘ফ্রি ভাইরাস’। অতীতে বিশেষ করিয়া বিদেশিরা ‘ফ্রি’ নামক টোপ দিয়া আমাদিগকে মুক্ত করিয়া অবশেষে জালে আবদ্ধ করিয়াছে।’...কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ইবনে সাজ্জাদ আরও লিখেছেন- পরীক্ষার হলে নকল ফ্রি, অফিস-আদালতে ঘুষ ফ্রি। ফ্রি স্টাইলে হাইজ্যাক, খুন, আসামী পলায়ন, নারী ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, শিশু নির্যাতন (গুম আর ক্রসফায়ার কেন বাদ পড়লো কী জানি !), খাদ্যে ভেজাল মিশানো সর্বত্র আজ ফ্রি’র উৎসব।

অধ্যক্ষ আহমদ হোসেন এর প্রতিটি লেখার শিরোনাম আপনাকে জানান দেবে বিরস রচনায় তিনি কতটা সিদ্ধহস্ত। কাঙালের বাসি কথা নামে বলাকা, মোমিন রোড, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত তার রম্য রচনা সংকলন গ্রন্থটির শিরোনামে একবার চোখ বুলালে আপনি তার রম্য রসের স্বাদে আটকা পড়তেই পারেন।

► বোগদাদী ছাই
► পন্ডিতত্রয়ের তালতত্ত্ব
► কর্মময় দিন নিদ্রাময় রাত্রি কবে আসিবে ?
► মি. এডিস ইন বাংলাদেশ
► হরতালের বীমা
► সুবচন নির্বাসন
► ভদ্র ও অভদ্র 
►গরিবের মরিয়া মরিয়া বাঁচিয়া থাকা
► গরু মারিয়া জুতাদান
► ছাগল নাচে খুঁটির জোরে
► ঝিকে মারিয়া বউকে শিখান
► বাঙালির তিন হাত 
► খালি পেটে গালি দাও প্রভৃতি। 
তিনি নিজের রচনায় একাধারে ঘটনা বা রূপকথার প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি চয়নে দক্ষতা, উপস্থাপনার পারদর্শিতা, বাক্য বুননের মুন্সিয়ানা এবং পাঠককে বয়ান-রসের বিপুল আকর্ষণে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
কায়েমী স্বার্থের কাছে মাথা নোয়ানো সুবিধাবাদী ‘বুদ্ধিজীবি’দের চরিত্র চিত্রণ করতে গিয়ে তিনি গোপাল ভাঁড়কে উদ্ধৃত করেছেন এভাবে-

রাজা : আর কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে ?
গোপাল ভাঁড় : তোষামোদ মন্ত্রণালয় স্থাপন করিতে হইবে। আমাকে সে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিয়োগ করিতে হইবে। এই মন্ত্রণালয় দেশের বুদ্ধিজীবীদের ক্রয় করিয়া লইবে। শিক্ষিত লোককে যত সহজে সহজে ক্রয় করা যায় নিরক্ষর লোককে, শ্রমজীবীদেরকে তত সহজে ক্রয় করা সম্ভব নহে।
রাজা : তাহারা কী করিবে ? 
গোপাল ভাঁড় : ভাল বেশ ! বেশ ! তত্ত্ব প্রচার করিবে। তার চয়িত কথাগুলোর ভেতর দিয়ে আমরা আজকের সমাজের তোষামোদ ব্যাধির স্বরূপ উন্মোচিত হতে দেখি। আজকাল আর তোষামোদের মতো দরকারি ‘পবিত্র কর্ম’ সম্পাদনের জন্য একটি মন্ত্রণালয় বড়ই অপ্রতুল হয়ে যায়; তাই অধিকাংশ মন্ত্রণালয়কে সেই গুরুত্ব দায়িত্ব যতেœর সহিত পালন করতে দেখা যায়।  

সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে পলায়নরত শান্তির শ্বেত পায়রার উড়াল দেখে লেখকের হৃদয় কেঁদে উঠে বলেই হয়তো তিনি এভাবে- মনের আক্ষেপ ঝেড়েছেন-‘ফুটবলের মতো রসগোল্লা আর গরুর গাড়ির চাকার মতো জিলাপী খাইবার আশা নাই। উন্নয়নের জোয়ারে আর অবগাহনের স্বপ্ন নাই। আমরা শান্তি চাই, কর্ম
কর্মময় দিন আর নিদ্রাময় রাত্রি চাই।’

অধ্যক্ষ আহমদ হোসেন সমাজকে খুব কাছ থেকে অবলোকন, পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করেছেন। তৃণমূল মানুষের সুখ-দুখ, হাসি-কান্না ও জীবনসমস্যার তীর্যক বিশ্লেষণ করেছেন। ঘূণেধরা সমাজের কতিপয় রীতি-রেওয়াজ ও প্রথা পালনের আড়ালে প্রান্তিক মানুষ ও দরিদ্র শ্রেণীর জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলার কথা এবং সমাজসৃষ্ট কিছু অকথিত কষ্ট আর দুর্দশার বয়ান তার শাণিত লেখনীতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি গরু মারিয়া জুতাদান শিরোনামের প্রবন্ধে লিখেছেন :  

রবিন্দ্রনাথ যদি এই যুগে বাঁচিয়া থাকিতেন তবে তাহার রচিত কাবুলিওয়ালা গল্পটা রচনা করিতেন কিনা সন্দেহ। কাবুলিওয়ালা গল্পে মিনির বাবা কন্যার বিবাহের ‘আলোকসজ্জার’ সমস্ত টাকা রহমতকে দিয়াছিল দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য। মিনির বাবা মনে করিয়াছিল ইহাতেই তাহার কন্যার কল্যাণ হইবে। না, এখন জৌলুস দেখাইতে পারিলেই যেন কল্যাণ ও শুভ হুমড়ি খাইয়া জামাই কন্যার বুকে পড়িবে।...এখনও এই দেশে মানুষ এক বেলাই খাইয়া জীবন ধারণ করে। ফুটপাতে নর্দমার পাশে মানবেতর জীবন যাপন করে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে। সেই দেশে বিবাহের এই বিলাসিতা গরীব মানুষের প্রতি উপহাস ছাড়া আর কিছুই নহে। 


------------------------------------------------------------------------------------------
খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
খুলশী, চট্টগ্রাম। ২৯.১০.২০১৫ বৃহস্পতিবার।
kmhamidullah@gmail.com
0177 9865882

Monday, November 27, 2017

এখন যা প্রয়োজন!


এখন যা প্রয়োজন!
(মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ আদীব হুজুর হাফিযাহুল্লাহ)
এখন প্রয়োজন চোখের পানি নয়, এখন প্রয়োজন জিহাদের আগুন। কলমের কালি নয়, এখন প্রয়োজন বুকের তাজা খুন এবং দুর্বলের ফরিয়াদ নয়, এখন প্রয়োজন বজ্রের গর্জন।

কিন্তু আমার মত কমযোর-বুযদিল চোখের পানি ও কলমের কালি ছাড়া আর কী ঝরাতে পারে! 
আমার বুকে তো নেই ঈমানের কুওয়াত, আমার দিলে তো নেই মুজাহিদের হিম্মত, আমার শিরায় তো নেই রক্তের সেই উচ্ছ্বাস! আমি শুধু কাঁদতে পারি আর লিখতে পারি। তাই ভেবেছিলাম, আজ এই নিঃসঙ্গ রাতে শুধু নিজেকে সান্ত্বনা দিতে অশ্রুর কালিতে আমি কিছু লিখবো।

আমি লিখবো আফগানিস্তানের নিঃসঙ্গ মুজাহিদের কথা,রক্তের সফরে যাদের সঙ্গী হলো না মুসলিম বিশ্বের কোন দেশ ও দেশ-নেতা।  তবু তারা শরীরের জখম এবং হৃদয়ের ক্ষত নিয়ে অবিচল রয়েছে জিহাদের পথে। অস্ত্র নেই, আশ্রয় নেই, অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, দুনিয়ার কোন উপায়-উপকরণ নেই। তবুও তারা পড়ে আছে পাহাড়ে-পর্বতে, গুহায়-গহবরে শুধু আল্লাহর উপর ভরসা করে।

ভেবেছিলাম, আমি লিখবো ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমানদের কথা, যাদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু এবং শহর ও জনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে ইহুদী হায়েনাদের হাতে। পঞ্চাশ বছর ধরে যারা দেশছাড়া বাস্তুহারা, যাদের বাঁচার কোন উপায় নেই আত্মঘাতী হামলা ছাড়া, কিন্তু মানবতার মোড়লদের চোখে তারা হলো সন্ত্রাসী, আর ইহুদী হায়েনা হলো শান্তিবাদী।

ভেবেছিলাম, আমি লিখবো গুজরাটের অসহায় বনী আদমের কথা, মুসলিম পরিচয়ের অপরাধে হিন্দু নরপশুদের হাতে যারা আজ ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম নিধনযজ্ঞের শিকার, অথচ মুসলিম বিশ্ব নির্বিকার! এটা নাকি ভারতের ভিতরের ব্যাপার! আর যারা মানবতার দাবিদার, কোথায় তাদের সভ্যতা? কোথায় তাদের মানবতা ও মানবাধিকার?

যেখানে জীবন্ত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়, নিষ্পাপ শিশুকে ত্রিশূলে গেঁথে হত্যা করা হয়, যেখানে আমার মা-বোনকে...
নাহ, আর পারছি না, আর সহ্য হয় না।

ভেবেছিলাম, আমি লিখবো আরকানের মুসলিমদের কথা, যারা ঐ নেড়া বোদ্ধৃদের হাতে জান, মাল, ইজ্জত-আবরু হারিয়েছে এবং যাদের শহর ও জনপদ সব শেষ হয়ে গেছে নেড়া বৌদ্ধদের হাতে। যুগ যুগ ধরে তারা দেশছাড়া বস্তুহারা, মানবাধিকার আজ অন্ধ, উলটো জঙ্গী তাকমা দিয়ে তারা এখন সন্ত্রাসী আর বৌদ্ধরা ধুয়া তুলসী পাতা।

ভেবেছিলাম আজ এই নিঃসঙ্গ রাতে শুধু নিজেকে সান্ত্বনা দিতে অশ্রুর কালিতে আমি লিখবো তাদের কথা যাদের সাথে আমার বন্ধন ঈমানের এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের, যাদের সাথে আমার সম্পর্ক একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গের। কিন্তু আমার চোখে আজ কান্না এলো না, আমার কলমে স্পন্দন জাগলো না। তাহলে? তাহলে কি ঈমানের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে গেলো আমার হৃদয় থেকে?

এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলার, এক ফোঁটা কালি ঝরাবার এবং একটু আর্তনাদ করার যোগ্যতাও কি হারিয়ে গেলো আমার?

হঠাৎ মনে হলো, আমার মাঝে এক নতুন সত্তা জেগে উঠলো এবং চাবুকের আঘাত আমাকে জাগিয়ে তুললো। এতদিন আমি চোখের পানিতে এবং কলমের কালিতে শান্তনা খুঁজেছিলাম,তাই নিজেকে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ নিজের মাঝে আমি যেন সত্যিকার আমাকে খুঁজে পেলাম। 

দিল থেকে আমার কমযোরি ও বুযদিলি এবং ভীরুতা ও অক্ষমতার অনুভূতি মুছে গেলো। আমার সমগ্র সত্তায় ঈমানের বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হলো এবং শিরায়-উপশিরায় সেই রক্ত টগবগ করে উঠলো যা একদিন ঝরেছিলো বদরে, উহুদে ইয়ারমুকে কাদেসিয়ায় এবং যুগে যুগে ইতিহাসের লালপাতায়।

আমার আল্লাহকে সাক্ষী রেখে আমি শপথ নিলাম, শুধু চোখের পানি নয়, শুধু কলমের কালি নয়, আল্লাহর রাস্তায় এবার ঝরবে আমার বুকের রক্তও। হে আল্লাহ! আমাকে আমি তোমার হাতে সঁপে দিলাম, যেভাবে তোমার পছন্দ আমার চোখের পানি, আমার কলমের কালি এবং আমার বুকের রক্ত তোমার দ্বীনের জন্য এবং তোমার পেয়ারা হাবীবের জন্য ব্যবহার করো।

আমি শুধু দেখতে চাই, দুনিয়াতে তোমার দ্বীন আবার যিন্দা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহ তার হারানো গৌরব আবার ফিরে পেয়েছে। ইসলামের হিলালী ঝাণ্ডা আবার সগৌরবে উড্ডীন হয়েছে। তাহলে আমি ভুলে যাবো বসনিয়া ও চেচনিয়ার বিভীষিকা। ভুলে যাবো ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের ভয়াবহতা। ভুলে যাবো এমনকি গুজরাটে আমার মুসলমান ভাইদের নিধনযজ্ঞের ও আরাকানি ভাই বোনদের বীভৎসতা।
(সূত্রঃ- আল-কলম/ ৩য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, রবিউল আউয়াল, ১৪২৩ হিঃ/ পুষ্প সমগ্র/ পৃঃ ৪১৪)

Friday, November 24, 2017

কাউকে অবজ্ঞা ও উপহাস করার পরিণতি!



মুফতী মুহাম্মদ তক্বী উসমান দা.বা.
অনুবাদঃ মুফতী মাহমুদ হাসান
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ ۖ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ ۖ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ ۚ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ [٤٩:١١]

মুমিনগণ,কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম। (সূরা হুজরাত, আয়াত-১১)

উক্ত আয়াতে “তাসখীর”-এর অর্থ হলো, কারো অসম্মান ও তাচ্ছিল্য করা। এমনভাবে কারো দোষ বর্ণনা করা,যাতে মানুষ তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে,এতে ওই ব্যক্তির অন্তরে ব্যথা আসে। এ ধরনের কাজ অনেক রকম হতে পারে।

যেমন,কারো চলাফেরা,উঠাবসা,কথাবর্তা,অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে ব্যঙ্গ করা,কারো শারীরিক গঠন ও আকার-আকৃতি নিয়ে কটূক্তি করা তার কোনো কথা বা কাজের ওপর ঠাট্টা করা। চোখ, হাত-পা দ্বারা টিকা-টিপ্পনী মারা ইত্যাদি এ সকল জিনিস অন্তর্ভুক্ত।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,“দুনিয়ায় যারা কাউকে নিয়ে উপহাস করে তাদের জন্য আখিরাতে জান্নাতের দরজা খোলা হবে এবং তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকা হবে। কিন্তু তারা যখন কাছে এসে জান্নাতের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে উদ্যত হবে তখনই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এভাবে বারবার তাদেরকে ডাকা হবে এবং প্রবেশ করতে গেলেই তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। একপর্যায়ে এভাবে করতে করতে সে নিরাশ হয়ে আর জান্নাতের দিকে ফিরে যাবে না। এভাবে দুনিয়ায় তার উপহাসের পরিণামে আখিরাতে তাকে নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা হবে।

অনর্থক কথায় ইহকাল ও পরকালীন ক্ষতি:
কিছু লোক ঠাট্টা ও উপহাসকে হাস্য-রহস্যের অন্তর্ভুক্ত মনে করে কাউকে উপহাস করে বসে,অথচ উভয়ের মাঝে বিস্তর ব্যবধান।

রসিকতা শর্ত সাপেক্ষে বৈধ,যা নবী করীম (সা.) থেকেও প্রমাণিত।
শর্ত হলো, এতে যেন অসত্যের মিশ্রণ না হয় এবং কারো মনে কষ্টের কারণ না হয়। তাও সর্বদা ও অভ্যাসগত যেন না হয়,বরং কখনো কখনো হয়ে যাওয়া মন্দ নয়।

কিন্তু যে উপহাস ও ঠাট্টার কারণে কারো মনে ব্যথা আসে তা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। এ ধরনের উপহাসকেও বৈধ রসিকতার অন্তর্ভুক্ত মনে করা মূর্খতা এবং গোনাহের কারণ।

কারো উপহাস করা মুখের গোনাহের মধ্য থেকে একটি বড় গোনাহ। আমি গত মজলিসে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এ কথা বলে ছিলাম যে অনর্থক কথা, অর্থাৎ এমন কথা বলা,যা দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণকর নয় তা মানুষকে কোনো না কোনো গোনাহে নিপতিত করার উসিলা হয়ে থাকে,তা থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। তা শুনে কোনো কোনো সাথী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে কখনো কখনো আমরা ঘরে বিবি-বাচ্চা ও মেহমানদের সাথে বিভিন্ন কথা বলে থাকি,ওই সময় কথা না বলে একদম চুপ করে থাকাটা মেহমানের হক্ব পরিপন্থী ও অসম্মান বোঝায় তখন কী করা উচিত?
তো ভালো করে বুঝে নেওয়া উচিত যে অনর্থক কথা বলা এক জিনিস,যাতে দ্বীন-দুনিয়া কোনোটিরই উপকার নেই এবং এর সাথে কারো হক্বও সম্পৃক্ত নয়।

অথচ আমাদের ওপর আমাদের বিবি-বাচ্চাদের হক্ব রয়েছে, তা আদায় করাও জরুরি। ইরশাদ হয়েছে, “তোমার ওপর তোমার নফসেরও একটি হক্ব রয়েছে এবং তোমার স্ত্রীরও হক্ব রয়েছে।” এখন যদি কোনো মানুষ অনর্থক কথা থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে বিবি-বাচ্চাদের সাথেও কথা না বলে,তাহলে তাদের হক্ব নষ্ট হবে,তা কখনো জায়েয হবে না।

অনুরূপ মেহমানের সাথে চুপ করে বসে থাকা ওই মেহমানের অধিকার হরণ হকে । মেহমানের সঙ্গে কিছু আলাপ-আলোচনা করা এবং তাকে খুশি করাও সাওয়াবের কাজ। আর তা একজন মুসলমানের প্রাপ্য। মেহমানের সম্মান করতে হবে। এর জন্য তার মন রক্ষার্থে তার সাথে কথাবার্তা বলতে হবে।
তবে হ্যাঁ,এসব কিছুরও একটি সীমা রয়েছে,সীমাতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।

মেহমানের হক্ব আদায়ের সীমা:
এ কথার ওপর আমার একটি ঘটনা স্মরণ হয়েছে। তা হলো অধিকাংশ সময় কিতাবাদি মোতালাআয় ব্যস্ত থাকি,বিশেষত যখন লাইব্রেরিতে মোতালাআর জন্য বসি,গবেষণার কাজে নিমগ্ন হই,কোনো বিষয় অন্তরে এলে কলম নিয়ে তা লিখতে উদ্যত হই;ঠিক তখনই কখনো কোনো মেহমান এসে পড়ে। সে সালাম-মুসাফাহা করে কথায় লেগে যায়। তখন এতে অন্তরে একটু বিরক্তির উদ্রেক হয় এবং বোঝা মনে হয়।

এ ব্যাপারে আমাদের হযরত শায়েখকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,ভাই! তুমি যে লেখালেখি ও পড়াশোনা করছ তা কি তোমার নফসের চাহিদা পূরণের জন্য করছ নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করছ। যদি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যই এগুলো করে থাকো তাহলে এ মুহূর্তে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি হচ্ছে মেহমানের সম্মান ও আপ্যায়ন করা। এটিই এ মুহূর্তের হক্ব ও অধিকার।

যদিও তুমি আজকের দিনে এই কাজ সম্পাদনের শিডিউল করেছ,তবে যেহেতু এখন মেহমান এসে গেছে,কাজের ফাঁকে মেহমানকেও একটু সময় দেওয়া তার হক্ব এবং আল্লাহর হুকুম। সালাম-কালাম ও সংক্ষিপ্ত কথাই হোক। মেহমানকে ওই সময় পর্যাপ্ত সময় না দিতে পারলেও সংক্ষিপ্ত কথার পর পরবর্তীতে অন্য সময় দিতে পারো।

আর যদি তোমার পড়াশোনা-লেখালেখির কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়,বরং তোমার নফসের চাহিদা পূরণার্থে হয় এবং মেহমানকে সময় দিতে কষ্ট হয়,তাহলে তা নফসের গোলামী হবে। এটি কোনো শরীয়ত নয়। যে সময় আল্লাহর যে হুকুম সে সময় তা করার নামই হলো শরীয়ত।
হযরতের এ কথার দ্বারা আমার এ ব্যাপারে সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। অর্থাৎ মেহমানের সাথে প্রয়োজন অনুপাতে সালাক কালাম ও আলাপ-আলোচনার দ্বারা সময় নষ্ট হয় না,বরং তা মেহমানের হক্বের অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ ও সন্তুষ্টির কারণ।

তবে হ্যাঁ,মেহমানকেও আপনার সময় এবং কাজের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। অযথা যেন মেজবানের সময় নষ্ট না করে। অতিরিক্ত ও অনর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত না হয়।

কারো উপহাস করা উচিত নয়:
প্রয়োজনাতিরিক্ত কথাও অনর্থক কথার অন্তুর্ভুক্ত। সাধারণ কথা থেকে টেনে শয়তান গোনাহের দিকে কখন যে নিয়ে যাবে তা টেরও পাওয়া যাবে না। আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ রয়েছে সিধেসাদা ও সরল প্রকৃতির। তাদেরকে নিয়ে কিছু মানুষ হাসি-তামাশা করে থাকে,সেই যেন একটা কৌতুকের বিষয় বস্তু। সে কৌতুক যদি এই পরিমাণে সীমাবদ্ধ হয় যাতে সে খুশি থাকে তাহলে তো আপত্তিকর নয়।

তবে যদি কৌতুক ও ঠাট্টা এ পর্যায়ে পৌঁছে যায়,যা তার অন্তরে কষ্ট দেয়,তার খারাপ লাগে,তাহলে এমতাবস্থায় উক্ত কৌতুক ও রহস্য অনেক বড় গোনাহের কারণ হবে।

কেননা তা বান্দার হক্বের সাথে সম্পৃক্ত। আর যে আয়াতটি আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম। সূরা হুজুরাতের আয়াত, যাতে আল্লাহ তাআলা মুআশারাতের দিকনির্দেশনামূলক বেশ কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। ইরশাদ করেন
لا يسخر قوم من قوم
“কেউ যেন কারো উপহাস না করে।”
عسى ان يكونوا خيرا منهم
“হতে পারে যাদেরকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে তারা (আল্লাহর নিকট) তোমাদের থেকে উত্তম।”
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেন, ولا نساء من نساء “অনুরূপ কোনো মহিলা অপর মহিলাকে তাচ্ছিল্য করবে না।” عسى ان يكن خيرا منهن “হতে পারে তাচ্ছিল্যকৃত মহিলা তোমাদের চেয়ে আল্লাহর নিকট উত্তম।”

কোরআনে কারীমের এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্টভাবে কাউকে নিয়ে উপহাস করতে শক্তভাবে নিষেধ করেছেন।

এই আয়াতে মহিলাদেরকে বিশেষভাবে দ্বিতীয়বার উল্লেখ করা হয়েছে,যদিও আয়াতের প্রথম অংশের দ্বারাই মহিলা-পুরুষ সকলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। তার পরও মহিলাদের ব্যাপারটা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ আল্লাহ তা’আলাই বেশি জানেন।
তবে এর দুটি হিকমত বোঝা যায়।

এক.
সাধারণত মহিলাদের মধ্যে এ অভ্যাসটি বেশি পরিলক্ষিত হয়,তাই তাদেরকে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

দুই.
যেহেতু পুরুষদের মজলিস ভিন্ন হবে এবং মহিলাদের মজলিস ভিন্ন হবে,তাই পৃথক পৃথক উল্লেখ করে বোঝানো হয়েছে যে পুরুষ-মহিলার মজলিস ও চলাফেরা ভিন্ন ভিন্ন হওয়া উচিত। আজকাল যেরূপ নারী-পুরুষের যে অবাধ মেলামেশা এ আয়াতে ইঙ্গিতে তা নিষেধ করা হয়েছে।

কাউকে ঠাট্টা ও উপহাস করা কবীরা গোনাহ:
যা হোক! উক্ত আয়াতে কাউকে উপহাস করাকে সুস্পষ্ট গোনাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিশেষভাবে এ কথাও বোঝানো হয়েছে যে তোমরা অন্যকে যে তাচ্ছিল্য করছ এর দ্বারা তোমরা নিজেকে বড় ও উত্তম ভেবেই অপরকে তাচ্ছিল্য করছ। এ তো চরম অহংকার যে নিজেকে উত্তম ভেবে অপরকে তুচ্ছ ভাবা হচ্ছে।

তবে স্মরণ রেখো,আল্লাহ তা’আলা বলছেন,“ওই সহজ-সরল সিধেসাদা যে ব্যক্তিকে তুমি তাচ্ছিল্য করছ,সে আল্লাহ তা’আলার নিকট কতটুকু মর্যাদাশীল। কারো শুধু চেহারা দেখেই তো তুমি বলতে পারবে না যে আল্লাহ তা’আলার সাথে তার কতটুকু সম্পর্ক।

প্রত্যেক বান্দার সঙ্গেই আল্লাহ তা’আলার বিশেষ একটি সম্পর্ক থাকে,এর মাঝে অনুপ্রবেশ করার কি অধিকার তোমার? তুমি কি জানো,সে আল্লাহর সাথে কী সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে, সে আল্লাহর কত প্রিয়? কারো শুধু বাহ্যিক অবয়ব দেখেই কোনো মন্তব্য করা যাবে না। কেননা মানুষ জানে না কার সাথে আল্লাহর সাথে আন্তরিকভাবে কতটুকু গভীর সম্পর্ক।

কাউকে জাহান্নামী বলা জায়েয নেই:
কতেক লোক কারো ব্যাপারে বলে দেয় যে সে তো জাহান্নামী,তার অমুক দোষ ইত্যাদি। নাউযুবিল্লাহ! কথাটি অনেক মারাত্মক কথা। জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা আল্লাহ তা’আলার হাতে। কাউকে এ ধরনের কথা বলা উচিত নয়।

আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন। বাহ্যিক কাউকে খারাপ,বদকার,ফাসেক মনে হলেও হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী (রহ.)-এর পরামর্শ হলো,তার ব্যাপারে এই চিন্তা করবে যে হতে পারে আল্লাহ তা’আলা তার ভেতর এমন কোনো ভালো গুণ রেখেছেন,যার বদৌলতে তার সাথে আল্লাহর সাথে এমন মজবুত সম্পর্ক হয় যার উসিলায় তোমার চেয়ে মর্যাদায় আগে বেড়ে যাবে। আজ যদিও মন্দ মনে হচ্ছে,কাল হয়তো আল্লাহর রহমতে এমন পরিবর্তন হবে যে সবাইকে পেছনে ফেলে দেবে।

কাউকে দেখে নিজেকে বড় মনে করা,তার থেকে নিজেকে উত্তম মনে করা এবং ওই ব্যক্তিকে ছোট মনে করাকেই তাকাব্বুর বা অহংকার বলা হয়। অহংকার মারাত্মক ক্ষতিকর একটি জিনিস।
আল্লাহ তা’আলা দয়া করে সকল মুমিনকে তা থেকে হেফাজত করুন।

গোনাহগারকে তাচ্ছিল্য করাও হারাম:
এ জন্য আল্লাহ তা’আলার উক্ত ইরশাদ ব্যাপকভাবে সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য –
عسى ان يكون خيرا منهم
“হতে পারে ওই সব লোক তাদের থেকে উত্তম।” বাক্যটি ব্যাপক,মুত্তাকী পরহেযগার, গোনাহগার সকলেই অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ- يا يسخر قوم من قوم বাক্যটিও ব্যাপক অর্থবোধক।

কেউ কারো উপহাস যেন না করে চাই উপহাসকারী যত বড় মুত্তাকী-পরহেযগারই হোক এবং উপহাসকৃত ব্যক্তি যত বড় ফাসেক ও গোনাহগারই হোক না কেন।

হ্যাঁ,এটা জায়েয আছে যে অমুক ব্যক্তির এ কাজটি গোনাহের কাজ এবং তা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে। কিন্তু গোনাহের কারণে গোনাহগার ব্যক্তিকে তাচ্ছিল্য ও অপমান করা বৈধ নয়।
কথাটি এভাবে বুঝতে পারো গোনাহগারকে মূলত অসুস্থ মনে করো। কেউ যদি কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তার ওপর দয়ার আচরণ করা হয়। তার সাথে রাগ করা যাবে না,তাচ্ছিল্য ও অপমান করা যাবে না।

তো গোনাহগার বেচারাও একজন গোনাহের রোগী। কে বলতে পারে,হয়তো আল্লাহর নিকট তার কোনো কাজ পছন্দনীয় হয়ে আছে,যার বদৌলতে তাকে মর্যাদাবান করে দেবেন।

এ জন্য কখনো কাউকে তাচ্ছিল্য ও উপহাস করা যাবে না। তুমি বাহ্যিকভাবে যত বড় মুত্তাকী-পরহেযগারই হও, কিন্তু হতে পারে তোমার চেয়ে ওই উপহাসকৃত ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অনেক মর্যাদাবান।

ইঙ্গিতেও কাউকে উপহাস করা বৈধ নয়:
কাউকে ইশারা-ইঙ্গিতে উপহাস করাও এর অন্তর্ভুক্ত। কারো কথাবার্তা,চালচলন বা গঠন-প্রকৃতি নিয়ে টিকা-টিপ্পনী মারা ও হাসাহাসি করা,যার কারণে সে কষ্ট পায়,তাও হারাম।

এক হাদীসে এসেছে,একদা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জনৈকা স্ত্রীর ব্যাপারে আলোচনা প্রসঙ্গে ঈঙ্গিতে তাঁর গঠন বেঁটে হওয়ার কথা বললেন,শুধুমাত্র হাতের ইশারায় তা বলেছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) তাঁকে বললেন,আয়েশা! তুমি মারাত্মক ভুল করেছ। হযরত আয়েশা (রা.)-কে কঠোরভাবে নিষেধ করলেন যেন কখনো কারো কোনো বিষয় নিয়ে তাচ্ছিল্য না করা হয়। যেরূপ সামনাসামনি কারো কোনো বিষয় নিয়ে এমন কথা বলা,যাতে ওই লোক কষ্ট পায়,তা তো মারাত্মক গোনাহ। সাথে সাথে উক্ত ঠাট্টা ও উপহাস যদি তার সামনে না করে তার অনুপস্থিতিতে করা হয় তাহলে তাতে দ্বিগুণ গোনাহ। উপহাস করার গোনাহ এবং গীবত করার গোনাহ।

হাসি-রহস্য ও উপহাসের মাঝে বিস্তর পার্থক্য:
কখনো কখনো বন্ধুদের মজলিসে পরস্পর হাসি-মশকরা হয়ে থাকে,যাতে এ কথা নিশ্চিত হয় যে এর দ্বারা কোনো সাথী মনে কষ্ট পায় না এবং ওই সব কথায় কেউ অপমান বোধ না করা নিশ্চিত হয় তাহলে তা বৈধ।

কিন্তু যদি এই সম্ভাবনা থাকে যে এর দ্বারা কারো মনে কষ্ট আসতে পারে কিংবা কেউ অপমান বোধ করবে তাহলে এ ধরনের হাসি-তামাশা কখনো বৈধ হবে না।

কারো উপহাস করার ভয়ংকর পরিণতি:
একটি হাদীসে এসেছে,যারা অন্য কারো উপহাস করে,তারা তো এই উপহাস করে বসেই থাকে,কিন্তু তাদের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। আখিরাতে তাদের সাথেও এ ধরনের উপহাস করা হবে। জান্নাতের দরজা খুলে তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকা হবে,কিন্তু তারা যখন এগিয়ে এসে দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবে,অমনিই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তারা ফিরে যাবে। এরপর পুণরায় দরজা খুলে তাদেরকে ডাকা হবে,আবার যেইমাত্র তারা এগিয়ে এসে ঢুকতে যাবে তখনই দরজা পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া হবে। এভাবেই তার সাথে বারবার উপহাস করতে থাকবে। একপর্যায়ে সে নিরাশ হয়ে আর জান্নাতের দিকে যাবে না। এই শাস্তি এই জন্যই যে তুমি দুনিয়ায় তোমার কথাবার্তায় কাউকে উপহাস করে কষ্ট দিয়েছিলে এখন দেখো এর মজা কী রূপ।

এ জন্যই সাবধান হওয়া উচিত,যেকোনো কথা বলার আগে মেপেজুখেচিন্তাভাবনা করেই তবে বলতে হবে।

রহস্য ও কৌতুকের সীমারেখা:
কেউ কেউ মানুষের উপহাস করাকে সাধারণ রহস্য ও কৌতুকের অন্তর্ভুক্ত মনে করে থাকে। অথচ উভয়ের মাঝে বিস্তর ব্যবধান।

হাসি-রহস্য হচ্ছে ওই সব কথাবার্তা,যার দ্বারা সকলের মনে প্রফুল্লতা আসে।
হযরত রাসূলে করীম (সা.) থেকেও তা প্রমাণিত। তবে শর্ত হলো, এ ক্ষেত্রে কোনো মিথ্যা ও অসারতার আশ্রয় নেওয়া যাবে না,কাউকে অপমান করা যাবে না। তাহলে তা বৈধ।
একটি হাদীসে এসেছে,জনৈকা বৃদ্ধা মহিলাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন,কোনো বৃদ্ধা জান্নাতে যাবে না। এতদশ্রবণে বৃদ্ধা মহিলা কান্না আরম্ভ করল। তখন রাসূল (সা.) সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,আসল কথা হলো বৃদ্ধ অবস্থায় কেউই জান্নাতে যাবে না। অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশের সময় আল্লাহ তা’আলা সকলকে যৌবন অবস্থা ফিরিয়ে দেবেন।

তো রাসূল (সা.) ওই বৃদ্ধার সাথে রহস্য করতে গিয়ে কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলেছেন,যা বৃদ্ধা বুঝতে পারেনি। তবে রাসূল (সা.)-এর কথায় অসত্যের মিশ্রণ হয়নি এবং ওই বৃদ্ধার মনে কষ্ট বা সম্ভ্রমহানিও হয়নি।

অনুরূপ একটি হাদীসে এসেছে,জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, তোমাকে আমি একটি উটের বাচ্চা দেব তখন লোকটি বলল,হুজুর! আমি তো বাহনের উট চেয়েছি,বাচ্চা দিয়ে কী কাজ হবে? রাসূল (সা.) বললেন,বাহনের উপযুক্ত বড় উটটিও তো কোনো একটি উটনীর বাচ্চা হবে।
সামান্য সময়ের জন্য রাসূল (সা.) লোকটির সাথে রহস্য করলেন। কিন্তু এতে কোনো অসত্যের আশ্রয় নেওয়া হয়নি এবং কাউকে কষ্টও দেওয়া হয়নি। এসব অবশ্যই বৈধ।

তবে এমন বৈধ কৌতুকও মাঝেমধ্যে হয়ে গেলে মন্দ নয়,কিন্তু নিয়মিত এতে লিপ্ত হয়ে যাওয়াও কাম্য নয়। মাঝেমধ্যে হলে ভালো।
তবে অবশ্যই ধর্তব্য যে এসব কৌতুক রহস্যের মধ্য দিয়ে কোনো মিথ্যার প্রচার যেন না হয়,কারো প্রতি দোষারোপ বা গীবত না হয়। সর্বোপরি কেউ যেন কষ্ট না পায়। অন্যথায় তা মারাত্মক গোনাহ হিসেবে বিবেচিত হবে।

সারকথা হলো,সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের উঠাবসা, চলাফেরা ও কথাবার্তা লাগাতার চলতে থাকে। মুখ দিয়ে কী বের হচ্ছে এর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই,এতে কি কারো মনে কষ্ট দেওয়া হয়ে যাচ্ছে কি না,তারও খবর নেই। কী হবে এর পরিণতি।

পরিণতি সম্বন্ধে বেখবর হওয়া কখনো উচিত নয়। দুনিয়ার কাজকারবারে লিপ্ত হয়ে আখিরাতকে ভুলে যাওয়া অত্যন্ত বোকামি।
এ কথা স্মরণ রাখা উচিত,দুনিয়া থেকে আমার চলে যেতে হবে,আল্লাহর সামনে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি কাজ ও কথার জন্য আমার জবাবদিহি করতে হবে।

অসতর্কতা ও গাফিলতিতে আমার থেকে যেন এমন কোনো কথা ও কাজ প্রকাশ না পায়,যার ফলে আখিরাতে আমার পরিণতি খারাপ হয়। এ জন্য সর্বদা অন্তরে আল্লাহ তা’আলাকে স্মরণ রাখবে। আল্লাহর নিয়ামতসমূহের শুকরিয়া জ্ঞাপন করবে।

সকল প্রয়োজনীয়তা আল্লাহর কাছে চাওয়ার অভ্যাস করবে। সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জীবনাচরণ অধ্যায়ন করবে। যেমন-আম্বিয়ায়ে কেরাম,সাহাবায়ে কেরাম ও নেককার ওলী-বুজুর্গদের জীবনী পড়ার দ্বারাও আখিরাতের ফিকির ও আল্লাহর স্মরণ লাভ হয়ে থাকে। যেরূপ নেককার ওলী-বুজুর্গদের সংশ্রবে থাকার দ্বারা আখিরাতের ফিকির লাভ হয়, তদ্রুপ তাদের জীবনাচরণ পড়ার দ্বারাও তা অর্জিত হয়। আল্লাহর ভালোবাসাপ্রাপ্ত বান্দাদের জীবনী-কথাবার্তা অধ্যায়নের দ্বারা অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা গভীর হয়। অন্তরে ঈমান তাজা হয়,গাফিলতি দূর হয়ে আখিরাতের ফিকির পয়দা হয়। এতে অযথা ও মন্দ কথাবার্তা-কাজকর্ম থেকেও মুক্ত হওয়া যায়। আল্লাহ তা’আলা নিজ দয়ায় আমাদের সকলকে এর তাওফীক দান করুন।

Thursday, November 23, 2017

একটি শিক্ষণীয় (বাস্তব) ঘটনা!

মালেক বিন আনাস রহি:
এক যুবক পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক যুবতীর প্রশংসা শুনে তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে না দেখেই বিয়ে করেন। স্ত্রীকে বাসর ঘরেই প্রথম দেখেন। কিন্তু স্ত্রীর ঘোমটা খুলতেই তিনি মনোবেদনায় বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। তিনি দেখেন যে, তার পরম কাঙ্ক্ষিত স্ত্রী রূপসী নয়, বরং কালো। তাই তিনি স্ত্রীর কক্ষ ত্যাগ করেন। মনের দুঃখে তিনি স্ত্রীর কাছে আর ফিরে আসেন না।

যুবকটির নাম আমের বিন আনাস। অবশেষে স্ত্রী নিজেই তার কাছে যান।
প্রিয় স্বামীকে বলেনঃ "ওহে প্রাণের স্বামী! তুমি যা অপছন্দ করছ, হয়তো তাতেই তোমার কল্যাণ নিহিত আছে, এসো…।

অতঃপর আমের স্ত্রীর কাছে যান এবং বাসর রাত যাপন করেন। কিন্তু দিনের বেলায় স্ত্রীর অসুন্দর চেহারার প্রতি তাকাতেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। মনের দুঃখে আমের এবার বাড়ি থেকেই চলে যান। চলে যান বহু দূরে অন্য শহরে।

কিন্তু বাসর রাতেই যে তার স্ত্রী গর্ভধারণ করেছেন, এ খবর তার জানা ছিল না। আমের ভিনদেশে বিশ বছর কাটান। বিশ বছর পর তিনি নিজ শহরে ফিরে আসেন। এসেই প্রথমে নিজ বাড়ির কাছের সেই প্রিয় মসজিদে ঢোকেন।

ঢুকেই দেখেন এক সুদর্শন যুবক পবিত্র কুরআনের মর্মস্পর্শী দরস পেশ করছেন, আর বিশাল মসজিদ ভরা মুসল্লিগণ পরম আকর্ষণে তা হৃদয়ে গেঁথে নিচ্ছে। তাঁর হৃদয়গ্রাহী দরস শুনে আমেরের অন্তর বিগলিত হয়ে যায়।

আমের লোকদের কাছে এই গুণী মুফাসসিরের নাম জানতে চাইলে লোকেরা বলেন, ইনি ইমাম মালেক। আমের আবার জানতে চান ইনি কার ছেলে? লোকেরা বলেন, উনি এই এলাকারই আমের বিন আনাস নামের এক ব্যক্তির ছেলে। বিশ বছর আগে তিনি বাড়ি থেকে চলে গেছেন আর ফিরে আসেননি।

আবেগে উত্তাল আমের ইমাম মালেকের কাছে এসে বললেন, আমাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে চলুন। তবে আমি আপনার মায়ের অনুমতি ছাড়া আপনার ঘরে প্রবেশ করবো না। আমি আপনার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবো, আপনি ভেতরে গিয়ে আপনার মাকে বলবেন, দরজায় একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বলছেনঃ

"তুমি যা অপছন্দ করছ, হয়তো তাতেই তোমার কল্যাণ নিহিত আছে।"
এ কথা শুনেই ইমাম মালেকের মা বললেন,
"হে মালেক! দৌঁড়ে যাও, সম্মানের সাথে উনাকে ভেতরে নিয়ে এসো, তিনিই তোমার বাবা। দীর্ঘদিন দূর দেশে থাকার পর তি নি ফিরে এসেছেন।"

সুবহানাল্লাহ!
এই হলেন সেই গুণবতী মা, যিনি ইমাম মালেকের মতো সন্তান গড়ে তোলার কারিগর....।
সুতরাং রূপবতী নারীতে নয় গুণবতী ও সৎ চরিত্রবান নেককার নারীদের দ্বারাই  এমন সন্তানের জন্ম নেয়।

Wednesday, November 22, 2017

মুসলিম উম্মাহর নাক কেটে কলঙ্কিত এক পরাজয় উপহার দিয়ে ইরাক সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে বিদায় নিল ইসলামিক স্টেট্স ইন্ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া

মুসলিম উম্মাহর নাক কেটে কলঙ্কিত এক পরাজয় উপহার দিয়ে ইরাক সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে বিদায় নিল ইসলামিক স্টেট্স ইন্ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া।
মাওলানা হারুন ইযহার
(মাওলানা হারুন ইযহার)
অহমিকা,হঠকারিত আর সীমালঙ্ঘনের অপরিহার্য পরিণাম হলো পতন। এর আগে একই বাড়াবাড়ির কারণে বিগত শতকের শেষ দশকের আলজেরিয়ায় সশস্ত্র তৎপরতা চুড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থ হয়েছিল। আলজেরিয়া, তিউনেসিয়ার তাকফিরের গোষ্ঠীই আই এসে যোগ দিয়েছিল।

অনেকে আই এসকে ইসরাইল- আমরিকার সৃষ্টি এবং অনেকেই তাদেরকে খারেজী মনে করেন।এসব তথ্য ভুল। চিন্তার অালস্য আর তথ্য সংগ্রহের সাধনা না করে এরকম সস্তা মন্তব্য আমাদের মজ্জাগত স্বভাব। তবে তারা এসব ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত ছিল তাদের অজানাতেই।

আমরা যদি বিচারমূলক মূল্যায়নে যেতে চাই তাহলে উম্মাহর ব্যর্থতার দৃষ্টান্তগুলো খুঁজে পাব মূলধারার নিয়মতান্ত্রিক ইসলামি আন্দোলনেও। উভয়টা ব্যর্থতা, রূপ ভিন্ন। একটা বাড়াবাড়ি একটা ছাড়াছাড়ি।
নিম্নে উভয় মানহাজের সমালোচনায় আমরা সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি। 

মূলধারার ইসলামপন্থাকে বিদ্যমান রাষ্ট্রিক ও সামাজিক কাঠামোর বেলায় جاهلية আর طاغوت এর মত Term গুলো ব্যবহার করতে দেখা যায়না। شرك এর আধুনিক আপডেট যা প্রচলিত ঐ রাষ্ট্রিক কাঠামোর সাংবিধানিক চেতনায় বিদ্যমান তাকেও আকিদাহ্'র পরিভাষা দ্বারা ক্রিটিক করতে দেখা যায়না। আবার এসব উপসর্গের উপশম করে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে মেথডগুলো কোরআন,সুন্নাহ্ তথা সীরাতে বিবৃত আছে পরিস্ফুটভাবে যেমন -دعوة جهاد هجرة نصرة ولاء براء صلح عهد بيعة -এসবের কোন প্রকার দৃশ্যমান বাস্তবতা দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাবেননা এখানে। 

অর্থাৎ এসব পরিভাষার অনস্তিত্ব প্রচলিত ইসলামপন্থার চিরাচরিত ব্যাপার।

তো এটা কি নিছক উদাসীনতা নাকি গোড়ায় গলদ? মানে ইসলামপন্থীরা রাজনীতির মেরুকরণে আকীদাহ্'কে বিবেচ্য মনে করেননা? নবীর সা. অনুসৃত পথ ও পদ্ধতিকে বিস্মৃতির সিন্দুকে তালাবদ্ধ রেখে দিয়েছেন?

হ্যাঁ,এমনটাই মনে হয় বাস্তব। 

তাহলে বলা যায় মূলধারার ইসলামপন্থা একটা রাজনৈতিক بدعة এ লিপ্ত হয়েছেন। তারা مرجئه না হয়েও إرجاء এর শিকার ।

গণতন্ত্রের পিছনে কোন শক্তিশালী اجتهاد এবং تاويل খাড়া করতে পারেনি ইসলামপন্থীরা। শুধু কিছু আকাবিরদের নজির পেশ করা ছাড়া। অথচ আকাবিরীনে দেওবন্দ বা ইখওয়ানের প্রথম সারির মুরব্বীগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে স্থায়ী মানহাজ্ মনে করেননি কখনো। 

এটা হলো ইসলাম চর্চায় تفريط বা স্খলনের উদহারণ।

তাহলে إفراط বা সীমালঙ্ঘনের নজির কারা? তারা হলেন যারা جاهليه,طاغوت এবং আধুনিক شرك - এসব পরিভাষার বিচারে বিদ্যমান কাঠামোর সমালোচনা করেন। এটা করে তারা প্রমাণ করলেন তাদের আকিদাহ্'র পাঠ কতোটা সহিহ এবং সুসংহত। চিন্তার এ জায়গায় তারা উম্মাহর জন্য সঠিক পথপ্রদর্শক হতে পারতেন। কিন্তু মসিবত হলো তারা তাগুত, শিরক আর জাহিলিয়াতের প্রতিকারে অবিলম্বেই সশস্ত্র পন্থার মেথড প্রচারে সিদ্ধহস্ত। دعوة বিবর্জিত جهاد এর এমন এক খোঁড়া ও প্রতিবন্ধী কর্মসূচি তারা হাতে নিয়ে ফেললেন যা তাকফিরের পরিধি বিস্তৃত করল এবং নতুন فتنةএর জন্ম দিল।

এই মানহজকে আমরা ফিৎনা বলছি কেননা তারা কুফফার কর্তৃক বন্দুকের জোরে দখলকৃত ভূমি আর কুফফারের আইনে পরিচালিত মুসলিম জন অধ্যুষিত এলাকা - সবটাকে একাকার করে ফেলেছেন। 

এখানে তাদের ভুলটা তাদের নিয়্যাহ্ বা আকিদাহ্'র মধ্যে না। সমস্যাটা فقه الواقع এর উপলদ্ধির মধ্যে। যেটা হয়েছে সামগ্রিক উসূলী দৃষ্টিভঙ্গির স্থলে শরীয়াহ্'র খন্ডিত টেক্সটের আবেগপ্রবণ পাঠের কারণে। আই.এস বা داعش হলো এর একটা নজির, যারা خوارج নন কিন্তু তারা সে চেতনা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ।

তাহলে সলিউশন কী?

অতি সংক্ষেপে, আই এস কে তাদের আগের মুরুব্বীদের বাই'আত আর নীতিতে ফিরে যেতে হবে,বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যাদের কতৃত্ব অক্ষুন্ন আছে এখনো অদৃশ্যভাবে।

আর ইসলামি রাজনীতির মূলধারাকে তাদের বিংশ শতকের পূর্বসূরিদের বৈপ্লবিক দা'ওয়াতের লিটরিচারে ফিরে যেতে হবে। ইখওয়ানকে ফিরতে হবে কুতুবে, জামাতকে ফিরতে হবে প্রতিষ্ঠাকালের সেই আগের মূল বয়ানে , আর কওমীকে ফিরতে হবে দেওবন্দের চার মূলনীতিতে। কেল্লা ফতেহ্!

Tuesday, November 21, 2017

ইসলামী শরীয়তে টুপির বিধানঃ পর্ব (১)

টুপি মুসলিম উম্মাহর জাতীয় নিদর্শন বাইসলামের অন্যতম ‘শিআর’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদগণ সহ সর্ব যুগে টুপি পরিধান করার প্রচলন মুসলিম সমাজে ছিল এবং অদ্যাবধি আছে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টুপিকে মুসলিম এবং কাফিরদের মধ্যে পার্থক্যকারী নির্ধারণ করেছেন। কাফিররা পাগড়ি পরিধান করে কিন্তু টুপি পরিধান করে না। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের পাগড়ির নিচে টুপি পরিধান করে বিধর্মীদের বিরোধিতা করার নির্দেশ দিতেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টুপি কিংবা পাগড়ি ব্যতীত খোলা মাথায় কখনও নামায আদায় করেছেন বলে কোন বিশুদ্ধ বর্ণনা পাওয়া যায় না।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ইদানিং কিছু মুসলমান টুপির ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন এমনকি একে অবজ্ঞা করার ও দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। নামাযের বাইরে তো দূরের কথা, নামাযের সময় ও তারা টুপি পরিধান করেন না এবং এ ব্যাপারে কোন দলীল প্রমাণ নেই বলে প্রচারণা চালান। কিছু প্রবাসী ভাই যারা আরব দেশগুলোতে থাকেন তারা এসে বলেন, আরবে নাকি টুপির রেওয়াজ বা গুরুত্ব নেই। খালি মাথায়ই তারা নামায পড়ে। তারাও একটি কারণ দর্শান, টুপির ব্যাপারে হাদীস শরীফে কোন বর্ণনা নাকি পাওয়া যায় না।

এই খানে আমরা টুপি প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস ও সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের আছার এবং কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করব যা টুপির ব্যাপারে সব ধরণের সন্দেহ ও দ্বিধা অপনোদনে সহায়ক হবে। পাশাপাশি ইসলামী বিশ্বের সর্বত্র অনুসৃত মাযহাব চতুষ্টয়ের ফতওয়া উল্লেখ করব।এবং বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টিতে টুপি ব্যাবহারের উপকারীতাও রয়েছে। সাধ্যানুযায়ী তার কিছু অলোচনা করার প্রয়াস চালাবো। সাথে সাথে টুপির ব্যাপারে অনীহা প্রদর্শনকারী মহল যাকে তাদের ইমাম মানে এবং যার তাহকীককে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করে সেই নাসিরুদ্দীন আলবানীর মতামতও আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশা আল্লাহ।

টুপির সংঙ্গাঃ
টুপি শব্দটি উর্দূ। হাদিস শরীফে টুপির জন্য তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
১. কালানসুয়াহঃ শাব্দিক অর্থ- লুকায়িত, ঢেকে দেওয়া বস্তু, এক প্রকারের মাথার পোশাক,
সুপরিচিত। ইংরেজী অভিধানে'কালানসুয়াহ'
এর অর্থ-Tall headgear,Tiara, Cidaris,
Hood, Cowl, Capuche, Cap.

পারিভাষিক অর্থঃ"কালানসুয়াহ বলা হয়,যা মাথার উপর পরিধান করা হয় এবং তার ওপর পাগড়ি পরিধান করা হয়।" (রদ্দুল মুহতার)

২. বুরনুসঃ এর অর্থ- এমন কাপড়, যার অংশ
বিষেশ মাথার সঙ্গে লেগে থাকে।(আর রায়েদ) ভাষাবিদ আল্লামা জাওহারীর মতে, বুরনুস বলা হয় লম্বা টুপিকে।হযরতমুতামের (রহ.)বলেন,আমি আনাস(রাঃ)-এর মাথায় লম্বা টুপি দেখেছি।(বোখারী শরীফ)

৩. কিমাম বা কুম্মাহঃ এর অর্থ গোল টুপি।(মিরকাত শরহে মিশকাত) প্রখ্যাত অভিধানবিদ আল্লামা মাজদুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনু ইয়াকুব
ফাইরোজাবাদী প্রনীত 'আল কামুসুল মুহীত' গ্রন্হে এবং বিখ্যাত আধুনিক অভিধান 'আলমুজামুল ওয়াসীত'-এও কুম্মাহ অর্থ গোল টুপি লেখা
হয়েছে। হাদীস শরীফে আছে, রাসূল (সাঃ) -এর টুপি এ ধরনের ছিলো যে তা মাথার সাথে লেগে থাকতো। (তিরমিযী শরীফ)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর টুপিঃ
টুপি পরিধান এবং পাগড়ি বাঁধা রাসূলের সুন্নত। রাসূলে আকরাম (সাঃ) মস্তকাবরন হিসেবে তিন প্রকারের পোশাক- টুপি,পাগড়ি ও রুমাল ব্যবহার করেছেন।নামায ছাড়াও সর্বাবস্হায় রাসূল(সাঃ),
সাহাবায়ে কেরামগন টুপি ব্যবহারের আমল ছিলো। হযরত হাফিয আবু শাইখ ইসফাহানী (রহ.) তাঁর ‘আখলাকুন নবী’ গ্রন্থে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর টুপির বর্ণনা নামক আলাদা একটি অধ্যায় সংযোজন করেছেন।এবং সেখানে তিনি অনেক গুলো হাদীস উল্লেখ করেছেন।সকলের স্মৃতিপটে বদ্ধমূল হওয়ার জন্যে নিম্নে তার থেকে ক টি হাদীস পেশ করা হলোঃ

১.হাসান বিন মেহরান থেকে বর্ণিত-

عن رجل من الصحابة : قال : أكلت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم، ورأيت عليه قلنسوة بيضاء فى وسط رأسه.

একজন সাহাবী বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তাঁর দস্তরখানে খেয়েছি এবং তাঁর মাথায় সাদা টুপি দেখেছি’ (আল ইসাবাহ ৪/৩৩৯)

এ হাদীসটি ইমাম ইবনুস সাকান তার কিতাবুস সাহাবায় সনদসহ বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর এ বর্ণনায় সাহাবীর নাম আসেনি। তা এসেছে তাঁর অন্য বর্ণনায় এবং ইমাম বুখারী ও ইমাম আবু হাতেমের বর্ণনায়। তাঁর নাম ফারকাদ। ( আততারীখুল কাবীর ৭/১৩১; কিতাবুল জারহি ওয়াত তা’দীল ৭/৮১)

উল্লেখ্য, ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. ইমাম ইবনুস সাকানের উপরোক্ত বর্ণনার দ্বারা আবু নুআইম আল আসবাহানী রহ.এর এ দাবি খন্ডন করেছেন যে, ফারকাদ সাহাবী আল্লাহর নবীর দস্তরখানে খাবার খাননি। বরং হাসান ইবনে মেহরান খাবার খেয়েছেন সাহাবী ফারকাদের সাথে। (মারিফাতুস সাহাবা ৪/১০৪)

হাফেজ ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ ক্ষেত্রে আবু নুআইমই ভুলের শিকার হয়েছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি ইমাম ইবনুস সাকানের উপরোক্ত বর্ণনাটি উল্লেখ করেন। এতে প্রমাণিত হয় এ বর্ণনা সহীহ। অন্যথায় প্রমাণ-গ্রহণ শুদ্ধ হতো না। এবং আবু নুআইম এর মত ইমাম এর কথাকে খন্ডন করা যেত না।

তাছাড়া সাহাবী ফারকাদ রা.এর আল্লাহর নবীর দস্তরখানে খাবার খাওয়ার কথা ইমাম বুখারী, ইমাম আবু হাতেম ও ইবনু আবদিল বারও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।

২. রাসূল(সাঃ)এর সহধর্মিনী,উম্মুল মু‘মিনীন হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত—

أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يلبس من القلانس في السفر ذوات الآذان، وفي الحضر المشمرة يعني الشامية.

সফরে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন টুপি পরিধান করতেন যা দ্বারা কান ঢাকা যায় এবং বাড়িতে অবস্থানকালে শামে তৈরি (সাধারণ) টুপি পরিধান করতেন।(আল জামে লিআখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামে পৃঃ২০২,
তারিখে দামেশক লিইবনিল আসাকিরঃ ৪/১৯৩,
আল জামিউস সগীর, হাদিসঃ১০০৯৩)

এ হাদীসের সকল রাবী ‘ছিকা’ তথা নির্ভরযোগ্য।উরওয়া ও হিশাম তো প্রসিদ্ধ ইমাম। আর মুফাদদাল ইবনে ফাদালা নামে দুইজন রাবী আছেন। একজন মিসরী, তিনি অনেক বড় ইমাম ছিলেন।মিসরের কাযী ছিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে তিনি ‘ছিকা’।

আসমাউর রিজালের কিতাবাদি থেকে প্রতীয়মান হয় সনদে উল্লেখিত ব্যক্তি ইনিই। কারণ তিনিই হিশাম ইবনে উরওয়া ও ইবনে জুরাইজ থেকে রেওয়ায়েত করেন যা আল্লামা ইবনে আদী ও আল্লামা মুহাম্মাদ বিন হাসান বিন কুতায়বা তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। (আল-কামিল ৭/৪০৯ ইকমালু তাহযীবিল কামাল ১১/৩৩৮) অপর জন বসরী। তাঁর স্মৃতিশক্তির বিষয়ে কিছু আপত্তি থাকলেও ইবনে হিববান তাকে ছিকা রাবীদের মধ্যে গণ্য করেছেন। আবু হাতেম বলেছেন يكتب حديثهআর ইমাম ইবনে আদী তার একটি বর্ণনাকে‘মুনকার’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাকিগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন-তার অন্য বর্ণনাগুলো সঠিক।’ সুতরাং সনদে উল্লেখিত রাবী যদি বসরীও হন তবুও তার এ বর্ণনা সঠিক।

৩. উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন-

الشهداء أربـعـة: رجل مؤمن جيد الايمان، لقى العدو ، فصدق الله حتى قتل ،فذلك الذى يرفع الناس اليه أعينهم يوم القيامة هكذا ، ورفع رأسه حتى وقعت قلنسوته، قال فما ادرى أقلنسوة عمر أراد أم قلنسوة النبى صلى الله عليه وسىلم ؟

শহীদ হল চার শ্রেণির লোক। এমন মুমীন যে তার বিশ্বাসে স্থির এবং দৃঢ়। শত্রুদের মুকাবেলায় সে শহীদ হয় এমন অবস্থায় যে সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপর পূর্ণ আস্থাবান ও বিশ্বাসী। 

কিয়ামতের দিন তার মর্যাদা এত উচ্চ হবে যে মানুষ তার দিকে এভাবে তাকাবে-এই বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মাথা তুললেন। তখন তাঁর টুপি পড়ে গেল। অথবা বলেছেন উমরের টুপি পড়ে গেল। বর্ণনাকারি বলেন, আমি জানি না কার টুপির কথা বলা হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের না উমর (রা.)-এর। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ১৪৬, জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৬৪৪)।

হাদীসটির ক্ষেত্রে ইমাম তিরমিযী বলেছেন, ‘হাসানুন গারীবুন।’অর্থাৎ হাদিসটির সনদ গ্রহনযোগ্য। যদিও হাদীসে টুপি কার সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে তথাপি বলা যায়, যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের টুপি হয় তবে তো বিষয়টি প্রমাণিতই। আর যদি হযরত উমর (রা.)-এর টুপি হয় তাহলেও তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতে খুলাফায়ে রাশেদীনের একজনের টুপি পরা প্রমাণিত হচ্ছে। আর খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহরই অংশ।

৪.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, একবার আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে একজন আনসারী সাহাবী তাঁর কাছে এলেন। এবং তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি ফিরে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আনসারী! আমার ভাই সাদ ইবনে উবাদাহ কেমন আছে? আনসারী বললেন, ভাল আছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের কে কে তাকে দেখতে যাবে? অতপর তিনি দাঁড়ালেন আমরাও দাঁড়ালাম। আমরা সংখ্যায় দশের অধিক হব। আমাদের পায়ে মোজাও ছিল না। চপ্পলও না। গায়ে জামাও ছিল না, টুপিও না। ঐ কংকরময় ভূমিতে আমরা চলছিলাম। অবশেষে আমরা সাদ এর নিকট পৌঁছলাম তখন তার পাশ থেকে মানুষজন সরে গেল। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীরা প্রবেশ করলেন।

এখানে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এর বাক্য ‘‘আমাদের পায়ে মোজাও ছিল না, চপ্পলও না। গায়ে জামাও ছিল না টুপিও না’’ থেকে বোঝা যায়, ঐ যুগে টুপিও ছিল লিবাসের অংশ।এবং কোথাও যাওয়ার জন্য সেগুলো রীতিমত আবশ্যকীয় এর ন্যয় ছিল। তাই এখানে এগুলো না থাকায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর তা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। বিষয়টি ঠিক এরকম যেমন ইমাম বুখারী রহ. সহীহ বুখারীতে বুরনুস প্রমাণ করেছেন। সহীহ বুখারীতে কিতাবুল লিবাসে ﺑﺎﺏ ﺍﻟﺒﺮﺍﻧﺲ নামে শিরোনাম দাঁড় করেছেন আর দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন হজের একটি হাদীস।

ﻻ ﻳﻠﺒﺲ ﺍﻟﻤﺤﺮﻡ ﺍﻟﻘﻤﻴﺺ ﻭﻻ ﺍﻟﻌﻤﺎﺋﻢ ﻭﻻ ﺍﻟﺒﺮﺍﻧﺲ

‘‘ইহরাম গ্রহণকারী জামাও পরবে না, পাগড়ীও না, বুরনুস (এক প্রকার টুপি)ও না।’’

আল্লামা আবু বকর ইবনুল আরাবী এ হাদীস থেকে পাগড়ী প্রমাণ করেছেন। তিনি বলেন, এ হাদীস প্রমাণ করে যে, তৎকালে পাগড়ী পরিধানের রীতি ছিল। এ কারণে ইহরাম অবস্থায় তা পরিধান করা নিষেধ করেছেন।

৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—

كان رسول الله صلى الله عليه وسىلم ،
يلبس قلنسوة بيضاء.

"রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদা টুপি পরিধান করতেন।(তাবরানী কাবীরঃ১৩/২০৪, আল জামিউস সাগীর, হাদিস নং১০০৯২)

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী(রহ.)ও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাবারানী হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন আর ইমাম সুয়ুতী তাঁর ‘সিরাজুল মুনীর’ গ্রন্থের ৪র্থ খ-, ১১২ নং পৃষ্ঠায় হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

৬. হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন— 

رأيت رسول الله صلى الله عليه وسىلم ،
وعليه قلنسوة بيضاء شامية .

"আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শামে (সিরিয়ার) তৈরি সাদা টুপি পরিহিত অবস্থায় দেখেছি।(শরহু মুসনাদি আবী হানীফা, পৃঃ ১৪২)

৭. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিন প্রকার টুপি ছিলো। সাদা তুলার আস্তরণ বিশিষ্ট টুপি, ডোরাদার ইয়ামানী চাদর দ্বারা নির্মিত টুপি এবং কান ঢাকা যায় এমন টুপি যা তিনি সফরকালে পরতেন এবং কখনো কখনো সালাত আদায়ের সময় সেটিকে সামনে রেখে দিতেন।(আখলাকুননবীঃ২/২২১-৩১৫)

ফায়দা: এ হাদীস থেকে জানা যায়, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন রকম টুপি ব্যবহার করেছেন। বর্তমানেও পবিত্র মক্কায় তুলার আস্তরণ বিশিষ্ট টুপির প্রচলন আছে এবং সেখানকার মানুষ সাধারণত এই টুপি ব্যবহার করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো ইয়ামানের তৈরি ডোরাদার কাপড়ের টুপিও ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া কান ঢাকা যায় এমন টুপিও তিনি ব্যবহার করেছেন। এ বিষয়ে এর আগের বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। শেষোক্ত ধরণের টুপি যেহেতু তিনি সফরের প্রয়োজনে ব্যবহার করতেন তাই সালাতের সময় তা খুলে সামনে রেখে দিতেন।

সীরাত প্রণেতা ইমামগণও আল্লাহর নবীর পোষাকের অধ্যায়ে তাঁর টুপির জন্যও আলাদা পরিচ্ছেদ লিপিবদ্ধ করেছেন। ইবনে হাইয়্যান বর্ণিত হাদীসগুলো তো আমরা এখানে উল্লেখ করলাম। এছাড়াও ইবনুল কায়্যিম,ইবনে আসাকির, ইবনুল জাওযী, শায়খ ইউসুফ সালেহী, আল্লামা দিময়াতী, বালাযুরীসহ আরো অনেক ইমাম তাদের সীরাত গ্রন্থে এ সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ সংযুক্ত করেছেন। কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় আমরা এখানে শুধু ইবনুল কায়্যিম (র.)-এর বক্তব্য তুলে ধরছি। তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘যাদুল মাআদ’-এ লেখেন, তাঁর একটি পাগড়ি ছিল, যা তিনি আলী (রা.) কে পরিয়েছিলেন। তিনি পাগড়ি পরতেন এবং পাগড়ির নিচে টুপি পরতেন। তিনি কখনো পাগড়ি ছাড়া টুপি পরতেন। কখনো টুপি ছাড়াও পাগড়ি পরতেন। (যাদুল মাআদ ১/১৩৫)

আলোচিত হাদীসগুলো দ্বারা টুপি ও তার প্রচলন প্রমাণে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।

ভারত সরকারের অনুদান প্রত্যাখ্যান করলো দারুল উলুম দেওবন্দ!

ভারত সরকারের অনুদান প্রত্যাখ্যান করলো দারুল উলুম দেওবন্দ!
কি অবাক হলেন?
দারুল উলুম দেওবন্দ

নতুন কিছু নয় সেই ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ শুক্রবারের কথা।চলুন এবার জেনে মূল আলোচনার কথা।
ভারতের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দেওবন্দের দারুল উলুম সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের অধীনস্থ মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার আধুনিকীকরণের জন্য তারা কোনও সরকারি অনুদান নেবে না।
নরেন্দ্র মোদী সরকার এ বছর তাদের বাজেটে মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কারের জন্য ১০০ কোটি রুপি বরাদ্দ করেছে, কিন্তু দারুল উলুম মনে করছে এই সরকারি সহায়তা নিলে তাদের মাদ্রাসাগুলোয় যে ধর্মীয় শিক্ষার পরম্পরা আছে তা ব্যাহত হবে।
দেওবন্দের দারুল উলুমের অনুমোদিত প্রায় তিন হাজার মাদ্রাসা আছে সারা দেশ জুড়ে আর এ সপ্তাহের গোড়ায় তাদেরই সংগঠন রাবতা-ই-মাদারিস-ই-ইসলামিয়ার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল দেওবন্দের ক্যাম্পাসে।
সেখানে ৪ হাজারেরও বেশি মৌলানার উপস্থিতিতে দারুল উলুম সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের শিক্ষাপদ্ধতি বা সিলেবাসের সঙ্গে কোনো আপস করা হবে না, আর তাই তাদের মাদ্রাসাগুলো এ জন্য সরকারি অনুদানও প্রত্যাখ্যান করবে।
দারুল উলুমের মাদ্রাসা বিভাগের অধিকর্তা মওলানা আবদুল খালেক এর কারণ ব্যাখ্যা করে বিবিসিকে বলেন, ‘দেড়শো বছরের পুরনো এই প্রতিষ্ঠান তাদের ইতিহাসে কখনও সরকারি অনুদান নেয়নি ভারতেরও না, বাইরের কোনো সরকারেরও না। দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতারাই এই বিধান করে গেছেন কারণ সরকারের টাকা নিলে তাদের কথাই তো আমাদের শুনতে হবে, আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারাব!’
বস্তুত দারুল উলুমের প্রধান আশঙ্কা এটাই সরকারি অর্থ নিলে তাদের পাঠক্রম বা পড়াশোনাতেও সরকার নাক গলাবে।
দারুল উলুমের উপাচার্য আবুল কাশেম নোমানিও জানিয়েছেন, আধুনিকতার নামে তারা তাদের মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার বিশুদ্ধতা নষ্ট করতে পারবেন না।
বহু বছরের অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও বামপন্থী রাজনীতিক মহম্মদ সেলিমও মনে করছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার চাইলে সরকারকে অন্য রাস্তায় এগোতে হবে।
তার মতে, ‘ধর্মীয় শিক্ষায় সরকারের কোনো ভূমিকা দরকার নেই, টাকা দেওয়ারও দরকার নেই। ধর্মীয় শিক্ষা তাদেরই কাজে লাগুক, যারা ছেলেদেরকে মওলানা-মৌলবী-কাজী বানাতে চান!’
মহম্মদ সেলিম আরও বলেন, ‘যেখানে সাধারণ স্কুল-কলেজ নেই বা শিক্ষক নেই, সেখানে অনেকটা বাধ্য হয়েই লোকে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। সরকার বরং বেশি করে স্কুল-কলেজ করুক তাহলে তাদের মাদ্রাসাতেও নাক গলাতে হবে না, মাদ্রাসাগুলোকেও সরকারি অর্থের ভরসায় থাকতে হবে না!’
বস্তুত সরকার দেশের যে সব মাদ্রাসায় নাক গলিয়েছে, সেখানে পড়াশোনা লাটে উঠেছে বলেই দাবি করছেন দারুল উলুমের কর্তৃপক্ষ।
মওলানা আবদুল খালেক বলেন, ‘সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত মাদ্রাসায় পড়াশোনা কিছু হয় না সেখানে শিক্ষকরা শুধু সরকারের কাছ থেকে মাইনে পেয়েই খালাস। তাদের পড়াশোনার তাগিদ থাকে না, ছাত্রদেরও শেখার গরজ থাকে না। দেশে সবচেয়ে বেশি সরকারি অনুদান-পাওয়া মাদ্রাসা আছে বিহারে, সেগুলোর সবই একেবারে মৃতপ্রায় দশা!’
ভারত সরকার অবশ্য মনে করছে, প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে ইংরেজি বা কম্পিউটার প্রযুক্তির মতো বিষয় এনেই ওই শিক্ষাপদ্ধতির সংস্কার করতে হবে এবং তার জন্য তারা অর্থ খরচেও প্রস্তুত।
কিন্তু দারুল উলুমের সিদ্ধান্ত থেকেই পরিষ্কার, মাদ্রাসা আধুনিকীকরণে সরকারের এই কর্মসূচী রীতিমতো প্রতিরোধের মুখে পড়তে চলেছে।

Sunday, November 19, 2017

শি‘আরা যে কাফের তার প্রমাণ কি?

যদি আপনাকে কেউ প্রশ্ন করে যে, শি‘আরা যে কাফের তার প্রমাণ কি?

তাহলে দেখে নিন শি‘আদের কুফরী ‘আক্বীদাহ বা বিশ্বাসের প্রমানসমূহ-

(তাদের ‘আক্বীদাহ-ব্শ্বিাসগুলো উল্লেখের সাথে সাথে তাদের লেখা কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে এজন্য যে, কেউ যেন একথা বলতে না পারে আমরা শি‘আদেরকে দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাফের কেন বলবো?)

১-আল্লাহ তা‘আলা কখনো কখনো মিথ্যাও বলে এবং ভুলও করে। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [উসূলে কা-ফী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৮। লিখক-ইয়াকুব কুলাইনী]

২-বর্তমানে যে কুরআন মাজীদ রয়েছে তা পরিবর্তিত। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [হায়াতুল কুলূব ৩য় খন্ড, পৃঃ ১০, মির্জা বাশারত হুছাইন]

৩-আমি ঐ আল্লাহকে রব মানি না, যিনি উছমান এবং মুআবিয়ার মত বদমাশদেরকে খলীফা বানিয়েছিলেন। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [কাশফে আসরার, পৃঃ ১০৭, খোমাইনী]

৪-মদ্যপায়ি খোলাফাদের সুবিধার্থে এ কুরআনের মধ্যে অদল-বদল করা হয়েছে। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [তরজুমায়ে মকবূর, পৃঃ ৪৭৯, মাকবূল হুছাইন দেহলভী]

৫-আল্লাহ তা‘আলা রিসালাতের বার্তা দিয়ে জিবরীলে আমীনকে পাঠিয়েছিলেন যে, ‘আলী (রদ্বিয়াল্লা-হু ‘আনহু)-কে রিসালাতের সু-সংবাদ দাও, কিন্তু জিবরীলে আমীন ভুল করে মু‘হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রিসালাতের সু-সংবাদ দিয়ে দিয়েছেন। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [আনওয়ারুন নু’মানিয়্যাহ, পৃঃ ২৩৭]

৬-হযরত ‘আয়িশাহ, হযরত আনাস বিন মালেক, হযরত আবূ হুরায়রাহ, হযরত ‘উমার বিন ‘আ-স, হযরত মু‘আবিয়াহ (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহুম আজমা‘য়ীন) খুবই মন্দ লোক ছিলেন। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [মুকালামাতে হুছাইনিয়াহ, পৃঃ ৪৯ (ইরানকর্তৃক পুরাতন ছাপা)]

৭-পুরুষ পুরুষের সাথে বিবাহ করা জায়েয এবং নিজের আপন মা,বোন এবং মেয়ের সাথেও বিবাহ করা জায়েযে আছে। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [ফেরকায়ে তা’লীফ আবী মু‘হাম্মাদ আল-হাছান বিন মূছা]

৮-আবূ বাকার আর ‘উমার (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহুমা)-এর খেলাফত স্বিকার করা কুফরী। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [তাফসীরে ইয়াশী, ২য় খন্ড, পৃঃ ৮৪]

৯- হযরত ‘উমার (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) প্রকৃত কাফের ছিলেন। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [কাশফে আসরারে খোমাইনী, পৃঃ ১১৯]

১০-আবূ বাকার এবং ‘উমার (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহুমা)-কে জাহান্নামের সবচেয়ে নিন্মের জাহান্নামে শিকল দিয়ে টেনে-হেছড়ে নিক্ষেপ করা হবে। (না‘ঊযু বিল্লাহ) [হাক্কুল ইয়াক্বীন বাকের মজলিসী, পৃঃ ৫০৯]

আল্লাহ্ (জাল্লা শা-নহু), আল্লাহ্‌র রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সা‘হাবায়ে কিরা-ম (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহুম আজমা‘য়ীনদের উপর এত জঘন্য অপবাদগুলো দেখার পরও কি আপনার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, তারা কি আসলেই কাফির?

Saturday, November 18, 2017

কওমি সনদের স্বীকৃতি, দলাদলি ও একটি পর্যালোচনা

মাহমুদ মুজিব ●
আল্লামা আহমদ শফি সাহেবের নেতৃত্বে সব শিক্ষাবোর্ড ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে সনদের সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে তুলকালাম ও বিতর্কের অবসান ঘটে। তার আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেকটা সাংঘর্ষিকও। ব্যক্তি নিয়ে মাতামাতি। বোর্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব। নেতৃত্বের ব্যাপারে অনৈক্য। মধ্যস্থতার প্রতি অনীহা। তারও আগের অবস্থা ছিলো আরও নাজুক। একপক্ষ স্বীকৃতি নিতে মরিয়া। অপরপক্ষ স্বীকৃতি নেয়া হারাম ভাবতেন। স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যতা বিনষ্টের অজুহাত দেখাতেন। তারা দেওবন্দের মরহুম মারগুবুর রহমান রহ.-এর ফতোয়া প্রচার করতে লাগলেন জোরেশোরে। তার সাথে মুফতি আব্দুর রহমান রহ.-এর একটা বক্তব্য গণহারে ছাপিয়ে বিতরণ করেছেন। অথচ যারা ইতোপূর্বে হযরতের ওফাত পর্যন্ত কোন বিষয়েই হযরতের সাথে একাত্মতা পোষণ করতেন না। এমনকি হযরতের সম্পৃক্ততা বা তত্ত্বাবধান সহ্য করতেন বলে মনে হতো না।

যাহোক অবশেষে স্বীকৃতি নেয়ার ব্যাপারে সকলে একমত। ওস্তাদুল ওলামা আল্লামা শাহ আহমদ শফি সাহেবের নেতৃত্বে, সরকারের আওতাবহির্ভূত হবে এ স্বীকৃতি।

(সনদ নিলে লাশ পড়া, অমুক সরকার থেকে স্বীকৃতি নেবো না) এমন সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে হঠাৎ করে সবাই সনদ নেয়া ও সরকারের সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎকার দেয়ার বিষয়ে অনেকে অনেক কিছু বলছেন। ব্যক্তিবিশেষকে দুষছেন। আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। সেদিকে যাওয়া অপ্রয়োজন মনে করছি। কমিটি গঠনের সময় হলো। কো-চেয়ারম্যান পদ ও প্রতিটি বোর্ড থেকে কতজন সদস্য করা হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব লাগলো। কমিটি গঠনের পর ১১ এপ্রিল ২০১৭ ইং গণভবনে শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম ও বোর্ড প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মর্মে ঘোষণা দেন যে, কওমী মাদরাসার স্বতন্ত্র-বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ও দারুল উলূম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরে কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদকে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবী) এর সমমান প্রদান করা হল ৷

দাওরায়ে হাদীসকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণার পর ১৫ মে ২০১৭ প্রথমবারের মতো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আল হাইআতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়া বাংলাদেশের অধীনে মোট ১৯ হাজার ৩৯৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।

পরীক্ষা গ্রহণের পর স্বীকৃতির আইনগত ভিত্তি অর্জনের লক্ষ্যে লিঁয়াজো কমিটি দুয়েকবার সরকারের সঙ্গে বসেছেন। সরকার একটা গঠনতন্ত্র, শিক্ষা সিলেবাস চাইলেন। লিঁয়াজো কমিটি তা উপস্থাপন করলো। হাইআতুল উলইয়ার জন্যে সরকার জমি বরাদ্দের ঘোষণা দিলেন।

পরবর্তীতে মঞ্জুরী কমিশন আইনের খসড়া তৈরি করার লক্ষ্যে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি এবং ইউজিসির ৪ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি কমিটি ঘোষণা করেন৷ যে কমিটিতে হাইয়াতুল উলইয়ার কোনোও প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি।

মঞ্জুরী কমিশন আইনের খসড়া তৈরি করার লক্ষ্যে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি এবং ইউজিসির ৪ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি কমিটি ঘোষণা করেন৷ যে কমিটিতে হাইয়াতুল উলইয়ার কোনোও প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি

গত ৯/১১/২০১৭ ইং তারিখ বেফাক ছাড়া অন্য ৫টি বোর্ডের দায়িত্বশীলগণ বেফাকের প্রতি অনিয়ম ও একক সিদ্ধান্তের অভিযোগ এনে ইত্তেহাদ মহাসচিব আল্লামা আব্দুল হালিম বেখারীর সভাপতিত্বে চট্টগ্রামে মিটিং করেন। ৫ বোর্ড ৫টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সরকারের সামরিক সচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সিদ্ধান্তগুলোর সমালোচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ খুব অতিরঞ্জন করে ফেললেন।

অন্যান্য ৫টি বোর্ডকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা শুরু হলো। আর কেউ বেফাককে একতরফা দোষারোপ করতে লাগলো। বেফাক সমর্থকরা বলছেন- বেফাক শীর্ষ বোর্ড, সর্বপ্রাচীন বোর্ড, মাদরাসা ও পরীক্ষার্থী বিবেচনায় বেফাক সবার ঊর্ধ্বে। বলা হয় অন্য বোর্ডগুলো আঞ্চলিক আর বেফাক হলো জাতীয় বোর্ড। তাই বেফাকের ক্ষমতা ও অধিকার বেশী।

যে যাই বলুক, একথা সর্বজনসম্মত যে, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়াহ বর্তমানে শীর্ষ বোর্ড। প্রচার ও প্রকাশনায় বাকি সব বোর্ড থেকে অনন্য ও উচ্চতায়। রেজাল্ট প্রকাশ অনলাইন সমৃদ্ধকরণ হয়েছে। এটা বেফাকের সফলতা বলা চলে।

তবে একথাও মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশ কওমি শিক্ষা নিয়ে আগে থেকে কয়েকটি বোর্ড ছিলো- আজাদ দ্বীনি এদারা, ঈত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ ( ১৯৫৯), তানযিমুল মাদারিসিল কওমিয়্যাহ, এসব বোর্ড না হলে বেফাকুল মাদারিসের অস্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠা কল্পনাও করা যেতো না। তাছাড়া সব শ্রেণির পরীক্ষা নেয়ার জন্য বেফাকের জন্মও হয়নি। অন্য বোর্ডের দায়িত্বশীলদের পরামর্শ ও অর্থ অনুদানের মাধ্যমেই বেফাক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমরা কারও কারও কিছু কিছু কর্মে খাই খাই মানসিকতা দেখতে পাই। তরুণ অনেকেই ইতিহাস জানে না। আঞ্চালিক বলে বলে একধরনের গালি দেয়া হচ্ছে প্রাচীন বোর্ডগুলোকে। পটিয়ার বোর্ডেতো সেই বগুড়ার হাজার হাজার মাদরাসাও পরীক্ষা দিতো। তাহলে এটা আঞ্চলিক বোর্ড হয় কি করে। আজাদ দ্বীনি এদ্বারা সর্বপ্রাচীন বোর্ড, এরপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে ইত্তেহাদুল মাদারিস, তানযিমুল মাদারিস, তারপরেই বেফাকুল মাদারিসের প্রতিষ্ঠা।

আঞ্চালিক বলে বলে একধরনের গালি দেয়া হচ্ছে প্রাচীন বোর্ডগুলোকে। পটিয়ার বোর্ডেতো সেই বগুড়ার হাজার হাজার মাদরাসাও পরীক্ষা দিতো। তাহলে এটা আঞ্চলিক বোর্ড হয় কি করে। আজাদ দ্বীনি এদ্বারা সর্বপ্রাচীন বোর্ড, এরপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে ইত্তেহাদুল মাদারিস, তানযিমুল মাদারিস, তারপরেই বেফাকুল মাদারিসের প্রতিষ্ঠা

তন্মধ্যে ১৯৫৯ ইং সনে আল জামেয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া চট্টগ্রামের মুহতামিম শায়খুল আরব ওয়াল আজম হাজী মুহাম্মদ ইউনুস রহ.-এর তত্ত্বাবধানে ইত্তেহাদুল মাদরিস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর ১৯৭৮ ইং সনে বেফাকুল মাদারিসের প্রতিষ্ঠা হয় ইত্তেহাদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিরই তত্ত্বাবধানে। পটিয়ার মুহতামিম হাজী সাহেব হুজুর আমৃত্যু ইত্তেহাদের পাশাপাশি বেফাকেরও সভাপতি ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর পটিয়ার পরবর্তী মুহতামিম আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী ইত্তেহাদ ও বেফাকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে তিনি বেশীদিন বেফাকে সম্পৃক্ত থাকতে পারেননি। কোনো একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পটিয়া ও বেফাক আলাদা হয়ে যায়। এতে ঢাকাস্থ দায়িত্বশীলদেও আন্তরিকতাকেই দায়ি করেন পটিয়ার আলেমগণ। বেফাক কার্যালয়ের জমিটি জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া ও ইত্তেহাদুল মাদারিসের ফান্ডের কেনা। এজন্যই বলতে চাই, যাকে নিয়ে নাচো, তার সম্পর্কে জেনে নাও না একটু। কারও অবদান কম নয়। এখন যারা ভোগ বিলাসে আত্মনিমগ্ন তাদের বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।

পরে অফিস নির্মাণের লক্ষ্যে জামেয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইত্তেহাদুল মাদারিসের বর্তমান সভাপতি আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী সৌদির এক সংস্থাকে দরখাস্ত করলে ইট, রড, সিমেন্টের ব্যবস্থা হয়। এসবের প্রমাণ ও সাক্ষীরা এখনো জীবিত আছেন। সুতরাং এসব অবদান ও ইতিহাস অস্বীকার করা বেফাকের অতিউৎসাহী সমর্থকদের পক্ষে বেমানান, অসুন্দর, অসম্ভবও বটে।

আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী সৌদির এক সংস্থাকে দরখাস্ত করলে ইট, রড, সিমেন্টের ব্যবস্থা হয়। এসবের প্রমাণ ও সাক্ষীরা এখনো জীবিত আছেন। সুতরাং এসব অবদান ও ইতিহাস অস্বীকার করা বেফাকের অতিউৎসাহী সমর্থকদের পক্ষে বেমানান, অসুন্দর, অসম্ভবও বটে

৫ বোর্ডের সমর্থকরা মিটিং নিয়ে যেমন মনে করছেন ঠিক তেমন নয়। বেফাকের প্রতি এসব অভিযোগ সরাসরি বেফাকের কর্নধার ও যথাযথ দায়িত্বশীলদের জানালে সমাধান হতো। হলেও হতে পারতো।

এখানে একটা বিষয় বলে রাখি, বেফাকুল মাদারিস যদিও ইত্তেহাদুল মাদারিসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কিন্তু তার বর্তমান অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় তাদের সম্মান প্রদর্শন করা উচিত।

বেফাক ও ৫ বোর্ড দ্বন্দ্বে বিতর্ক না করাটাই ভদ্রতার বহিঃপ্রকাশ। আর এ বিতর্কের অবসান ঘটাতে ৬ বোর্ডের দায়িত্বশীলগণ আবারও একটেবিলে বসতে হবে। তাহলে পরস্পর দোষাদোষি বন্ধ হবে। ছোটোখাটো মতপার্থক্যের কারণে সনদের স্বীকৃতি যেনো থেমে না যায় এটাই কামনা থাকবে। আর স্বীকৃতির নামে যেনো কোন বিকৃতি না হয় সেদিকটিও লক্ষ্য রাখতে হবে। সমালোচনার জন্য ভদ্রতা জ্ঞানও আবশ্যক। সবার আগে বাস্তব ইতিহাস জানা উচিত। তারপর বাক্যস্তুতি জাতিকে জানানো উচিত।

লেখক : কওমী মাদরাসা ছাত্র পরিষদ বাংলাদেশ-এর সেক্রেটারি ও জামেয়া দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রাম-এর শিক্ষক।

সৌদি প্রধান মুফতী বিরোধী অপ-প্রচার উম্মার জন্য আত্মঘাতী

গতকাল থেকে কিছু মিডিয়ার সূত্র ধরে সৌদি গ্রান্ড মুফতীকে বিভিন্ন মহল থেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে যা সুন্নী মুসলীমদের জন্য আত্মঘাতী। তিনি নাকি ফতোয়া দিয়েছেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ! তাই গ্রান্ড মুফতি আবদুল আজিজ আল শেখের নাকি ভূয়শী প্রশংসা করেছেন ইসরাইলের যোগাযোগ মন্ত্রী"।

ফেইসবুকে সাধারণত কোন নিউজ শেয়ার করলে অনেকে লিংক খোঁজেন। লিংক দিলেই যেন দলীল হয়ে গেল! আচ্ছা লিংকের সব দলীল কি সত্য? মোটেই নয়। যেমন, কয়েকমাস আগে বাবরী মসজীদের জন্য ভোট চেয়ে ব্যাপাকভাবে একটি লিংক ছড়িয়ে দেয়া হয়। সে ফাঁদে আবেগে পা দেন উচ্চশিক্ষিত -নিম্ন শিক্ষিত সবাই। কেউ বিরোধীতা করলে দুইচারটা লিংক দেয়া হত। পরে জানা গেল বিষয়টা পুরা ভুয়া! এভাবে ভুয়া নিউজের হাজারো উদাহারণ দেয়া যাবে।

অনেকে বলবেন ফতোয়ার নিউজটি অমুক-তমুক জাতিয় দৈনিক প্রকাশ করেছে! আচ্ছা, জাতিয় দৈনিকের সব খবর কি নির্ভুল বা বিশ্বাস যোগ্য? যেমন, ৫ ইমে হেফাজত ইসলামের বিরুদ্বে হাজার-হাজার গাছ কাটা আর পবিত্র কোরান পোড়ানোর নিউজ করেছিল দেশের প্রায় মিডিয়া। হেফাজত ইসলামের সেই কোরান পোড়ানোর অভিযোগ কি বিশ্বাস যোগ্য? অবশ্য নাহ, কিন্তু আপনার কাছে চরম অবিশ্বাস্য এই খবর বিদেশীদের কাছে বিশ্বাস যোগ্য করে তুলতে পারে মিডিয়া। তারাও জাতিয় দৈনিকের রেফারন্স দিবে তাই না? সৌদি গ্রান্ড মুফতী অনুরুপ কোন ইসলাম বিদ্ধেষীদের চক্রান্তের শিকার বলে আমি মনে করি।

শিয়া-সুন্নী ইস্যুতে উত্তপ্ত মধ্যেপ্রাচ্য। সুন্নী ওলামা এবং সৌদি বিদ্ধেষ ছড়িয়ে আমাদেরকে বিভক্ত করার ফাঁদের কথা কি একবারও ভেবে দেখেছেন? সৌদির গ্রান্ড মুফতী একজন বিশ্ববরেণ্য ইসলামী স্কলার, সম্মানিত ব্যাক্তি। তিনি সে মহান সৌভাগ্যবান আলেম যিনি বছরের পর বছর আরফাতে খোৎবা দিয়েছেন। ওনার জ্ঞানের বিশালতা মহান রবের নেয়ামত। আপনি যে পক্ষের বা যে মতবাদের হোন না কেন উম্মার এই মহান রত্নের বিপক্ষে কিছু বলার আগে নিজের অবস্থান ভেবে দেখা দরকার।

আচ্ছা যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম, তিনি হয়ত এই ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু ফতোয়ার মূল প্রেক্ষাপট না বুঝলে কোন ফতোয়া বুঝা যাবেনা। যেমন, দরুণ উদাহারণ স্বরুপ আমি একটা ফতোয়া দিই! কেউ আমাকে প্রশ্ন করলো ইসরাইলী ইহুদী হত্যা কি জায়েজ? উত্তরে আমি বল্লাম, বিনা বিচারে অন্যায়ভাবে কোন মানুষ হত্যা জায়েজ নাই, সে ইয়াহুদী,খৃষ্টান হোক বা অন্য যে কোন ধর্মের হোক। এখন কেউ মিডিয়ায় শিরোণাম করে দিতে পারে ইসরাইলী ইহুদী হত্যা হারাম ফতোয়া দিয়েছে শিশির!"। এখানে মিডিয়ার শিরোনাম সত্য কিন্তু ফতোয়ার মূল জবাব বিকৃত, লুকায়িত। অনুরুপ কোন আলেম যদি বলে মরা গরুর মাংস জায়েজ! তখন এই ফতোয়ার প্রেক্ষাপট, অবস্থা বিশ্লেষণ না করলে বিভ্রান্ত হবে। আপনি এমন স্থানে গেছেন যেখান মরা গরুর মাংস ছাড়া কিছু নাই, তখন বাধ্য হয়ে জান বাঁচানোর জন্য মরা গরুর মাংস ভক্ষণ জায়েজ। এর মানে, এই নয় সর্বাবস্থা মৃত গরুর মাংস হালাল। কিন্তু মিডিয়া শিরোনাম করে দিতে পারে অমুক মাওলানা ফতোয়া দিয়েছে মরা গরুর মাংস হালালা!

আমি বুঝাতে চেয়েছি যে কোন ফতোয়ার মূল প্রেক্ষাপট, ফতোয়ার ভিত্তি বিচার বিশ্লেষণ না করলে সব উলোটপালুট হয়ে যাবে। তাছাড়া বর্তমান যুগে ভিডিও পর্যন্ত কাটছাঁট করে বিকৃত করে ফেলা হয়। তাই কারো বক্তব্য বিকৃত করা কোন ব্যাপার না। মুফতী সাহেবের ফতোয়ার নিউজ শতভাগ শত্য অথবা সম্পূর্ণ মিথ্যা কোনটাই দাবী করতেছিনা। তবে ওনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

সৌদি গ্রান্ড মুফতী পুরা উম্মার শ্রদ্ধেয়, সম্মানিত ব্যাক্তি। কোন বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও উনার সম্মানহানি আত্মঘাতী। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন, উম্মার ঐক্য দৃঢ় করার তাওফিক দান করুন।

আমার এই লেখা যৌক্তিক মনে হলে কপি/শেয়ার করতে পারেন। ভুল বা দ্বিমত থাকলে তাও জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।

ফেসবুক-Muhammad Hasanথেকে সংগ্রহ

রোযার ফযিলত সমূহ!


(১) রোযার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেনঃ হাদীসে কুদসীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, বনী আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দিব।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫, ৫৫৮৩ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬০)

(২) রোযা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১০ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮১৭)

(৩) রোযা জান্নাত লাভের পথঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। রোযাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৯৭ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬৬ )

(৪) রোযাদারের জন্য রোযা শাফায়াত করবেঃ উত্তম সনদে ইমাম আহমাদ ও হাকেম বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য শাফায়াত করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে দিবসে পানাহার ও কামনা চারিতার্থ করা থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে আমাকে শাফায়াত করার অনুমতি দিন।’’ (মুসনাদ, হাদীস নং ৬৬২৬, আল-মুস্তাদরাক, হাদীস নং ২০৩৬)

(৫) রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তমঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! রোযাদারের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধিময়।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯৪ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬২)

(৬) রোযা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তি লাভের উপায়ঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘রোযাদারের জন্য দু’টো খুশীর সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫ ও সহীহ মুসলিম, হদীস নং ২৭৬৩)

(৭) রোযা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢালঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বৎসরের দূরত্বে নিয়ে যান।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৬৮৫ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬৭ )

ইমাম আহমাদ বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন – রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘রোযা ঢাল স্বরূপ। যা দ্বারা বান্দা নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারে, যেভাবে তোমাদের কেউ একজন যুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করে।’’ (মুসনাদ, হাদীস নং ১৭৯০৯)

(৮) জাহান্নামের অগ্নি থেকে সত্তর বছরের রাস্তা পরিমাণ দূরবর্তী হওয়াঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে কেউ আল্লাহর রাস্তায় (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য) একদিন সিয়াম পালন করবে, তা দ্বারা আল্লাহ তাকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে সত্তর বছরের রাস্তা পরিমাণ দূরবর্তীস্থানে রাখবেন’’। [সহীহ মুসলিম : ২৭৬৭]

আধ্যাত্মিকতা- ইসলামে আধ্যাত্মিক চেতনা এবং বুযুর্গানে দীনের ত্যাগঃ

যুগে যুগে মহা-মনিষীগনই ইসলামের জন্য অনেক ত্যাগ দিয়েছেন।

কুতুবে যামান আলহাজ শাহ মুহাম্মদ ইউনুস (রহ.)। তিনি এ জামিয়া পটিয়ার দ্বিতীয় মুহতামিম। তাঁকে ছাত্র অবস্থায় তার মুরশিদ মাওলানা জমির উদ্দিন (রহ.) খিলাফত দান করেছেন। হযরত মুফতী আজিজুল হক (রহ.) ১৯৬০ সালে ইন্তিকাল করেন। ইন্তিকালের চার বছর আগে হাজী ইউনুস (রহ.)-কে মুহতামিম নিযুক্ত করেন। পটিয়া মাদরাসার বার্ষিক সভায় মুফতী সাহেব হুযুর (রহ.) হাজী সাহেব হুযুর (রহ.)-কে সকলের সামনে দাঁড় করিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘আপনারা এই মাদরাসা ব্যাপারে তাঁর সাথে যোগাযোগ করবেন। এখন থেকে তিনিই মুহতামিম।’ ১৯৬০ সালে হুযুর ইন্তিকাল করলেন। এর চার বছর আগে যদি হয়, তাহলে ১৯৫৬ সালে তিনি মুহতামিম হন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত একাধারে তিনি জামিয়া পটিয়ার মুহতামিম ছিলেন। এ সকল বুযুর্গানে দীন আজকে নেই। আমাদেরকে তাঁদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে হবে।

হিন্দুস্থানে এক হাজী সাহেব ছিলেন; হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)। তিনি হযরত হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রহ.) ও ইমামে রব্বানী হযরত রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.)-এর পীর ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন করে ছিলেন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য তালাশ করছিল। তিনি তাঁর এক মুরিদের বাসায় আশ্রয় নিলেন। শত্রুদের কাছ থেকে আত্মগোপন করে থাকা এটাও একটা সুন্নত।

আল্লাহ পাক আমাদেরকে রসূল স্বঃ-এর প্রতিটি সুন্নাহ্‌র্‌ উপর মু’হাব্বাতের সাথে আমল করার তাউফীক্ব দান করুণ। আমীন ইয়া রব

রসুলে আকরাম স্বল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হলেন, গা-রে ছাউর নামক গুহায় রসুল (স্বঃ) কয়েকদিন আত্মগোপন করেছিলেন। আমাদের মুরুব্বিরা এই সুন্নতও পালন করে গেছেন। জেলখানায় থাকাও সুন্নত। আমাদের মুরুব্বিরা সে সুন্নতও পালন করেছেন।

হাজী ইউনুস সাহেব (রহ.) বাংলাদেশ স্বাধীনতা উত্তর একাধারে দু’বছর আত্মগোপনে ছিলেন। কিন্তু মাদরাসা তাঁকে ছাড়েনি। এই আত্মগোপন অবস্থায় হুযুরের বাড়ির সামনে বর্তমানে ইসাপুর মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) আত্মগোপন করলেন তাঁর এক মুরিদের বাসায়। মুরিদ ছিলেন বড় শিল্পপতি। ইংরেজ অফিসারের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। ইংরেজ অফিসারও মাঝেমধ্যে তাঁর মুরিদের বাসায় আসত। মুরিদ বললেন, হুযুর! আমার বাসায় তো ইংরেজ অফিসাররা আসেন। এখন হঠাৎ যদি আপনাকে দেখে ফেলে তবে তো গ্রেফতার করে ফেলবে। হুযুর! বে-আদবি মাফ করবেন। আমি ঘোড়ার ব্যবসা করি। বাড়ির পেছনে ঘোড়া রাখার একটি ঘর আছে। ওই ঘরেই আপনার জন্য স্থান করে দেওয়া হবে। ইংরেজ অফিসার আসলে তারা তো আর সেখানে যাবে না; আপনার নিরাপত্তার জন্য! ব্রিটিশের গোয়েন্দা বিভাগ স্ট্রং ছিল, তারা খবর পেল, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) অমুখ ব্যক্তির বাসায় ঘোড়া ঘরে অবস্থান করছেন। খবর পেতেই এক ইংরেজ অফিসার আসল ওই ব্যক্তির কাছে। বলল, ভাই! আমার একটা ঘোড়া দরকার। আপনার নাকি ভালো ঘোড়া আছে? তাহলে যেখানে ঘোড়া রাখেন, সেখানে একটু গিয়ে দেখব; কোন ঘোড়াটা ভালো? আসলে সে ঘোড়া দেখতে আসেনি। তার মূল টার্গেট হল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)।

অফিসার ঘোড়া দেখার জন্য গেল। এ দিকে মুরিদ থরথর কাঁপছিল; তিনি মনে করছেন, হুযুর তো এখনই ধরা পড়বেন! এখন আমার ঘোড়ার কামরায় যাচ্ছে অফিসার। অফিসার সেখানে পৌঁছার আগে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) নামায পড়ার জন্য অযু করেছিলেন। জায়নামায বিছানো ছিল, অফিসার ও মুরিদ রুমে গিয়ে দেখেন, জায়নামায বিছানো আছে, অযুর পানি দেখা যায়, কিন্তু মানুষ নেই। “সুবহানাল্লাহ” হুযুরকে পাননি তারা। অফিসার চলে যাওয়ার পর মুরিদ চিন্তা করলেন, আমার হুযুর আবার কোথায় চলে গেলেন? তিনি তো এখানে ছিলেন। কোথায় গেলেন? রুমে এসে দেখেন হুযুর সাজদায় আছেন। ইতঃপূর্বে কিন্তু আল্লাহপাক তাঁকে তাদের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রেখে ’হিফাযত করেছেন। আল্লাহ যদি হেফাযত করেন, তবে কেউ কি কিছু করতে পারে?
فَاللّٰهُ خَيْرٌ حٰفِظًا١۪ وَّهُوَ اَرْحَمُ الرّٰحِمِيْنَ۰۰۶۴ {يوسف}

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সেই আল্লাহ পাকই হেফাযত করেছেন। তিনি এই মাত্র প্রবেশ করেছে সাথে সাথে কবুতর বাসা বাঁধল, মাকড়সার বাসাও দেখা দেখ। শত্রুরা এসে এদিক সেদিক তালাশ করে। কিন্তু সেই গুহায় তাকায় না। বলতে লাগল, যদি এখানে প্রবেশ করতো তবে কবুতরের বাসা ভেঙে যেত। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.) বললেন, হুযুর! শত্রুরা তো গুহার মুখে এসে পৌঁছেছে। এখন তো আমরা ধরা পড়ব। হুযুর আকরাম (সা.) ইরশাদ করেন,

اِذْ يَقُوْلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحْزَنْ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَاۚ ۰۰۴۰ {التوبة}

আবু বকর! চিন্তার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ সাথে আছেন। রাখেন আল্লাহ মারে কে? শত্রুরা গর্তের পাশেই এসেছিল। কিন্তু ওদিকে নযর দিতে পারেনি। আল্লাহ হেফাযত করেছেন।

এবার আসেন, বাংলাদেশের হাজী সহেব। হাজী ইউনুস (রহ.) যখন আত্মগোপনে ছিলেন। শহরে একটি দু’তলা বাসায় হুযুর অবস্থানগ্রহণ করেছিলেন। পুলিশ খবর পেল। হুযুরকে গ্রেফতার করার জন্য তারা ওই বাসাটা চতুর্দিকে ঘেরাও করে ফেলল। তারপর উপরে উঠে গ্রেফতার করবে। হুযুরের সাথীরা ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন। এখন কী হবে? পুলিশ তো ঘেরাও করে রেখেছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের সামনে হুযুর বের হয়ে চলে গেলেন। তারা হুযুরকে দেখতে পায়নি। আল্লাহু আকবর।

নফসের জিহাদই সবচেয়ে বড় জিহাদ

এ সকল বুযুর্গানে দীন আল্লাহর কাছে এমন মর্যাদা কীভাবে পেলেন? তারা নফসে আম্মারার সাথে জিহাদ করেছেন। নফস তিন প্রকার। যথা- ১. নফসে আম্মারা, ২. নফসে লওয়ামা ও ৩. নফসে মুতমায়িন্না। এসব কথা কুআন শরীফে আছে, ইরশাদ হচ্ছে,

وَمَاۤ اُبَرِّئُ نَفْسِيْ١ۚ اِنَّ النَّفْسَ لَاَمَّارَةٌۢ بِالسُّوْٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّيْ١ؕ اِنَّ رَبِّيْ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ۰۰۵۳ {يوسف}

আম্মারা মানে, বেশি বেশি আদেশ করে, খারাপ কাজের দিকে বেশি বেশি আদেশ করে। নফসে আম্মারার সাথে যখন জিহাদ করবে নামায-রোযা ও যিকরের মাধ্যমে তখন এই নফসে আম্মারার চিকিৎসা হবে। বুযুর্গানে দীন বলছেন, নফসে আম্মারাকে যদি দুর্বল করতে না পার। তোমার জন্য জাহান্নাম অবধারিত।

কীভাবে দুর্বল করবে তাকে? নফস বিশেষজ্ঞের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে। গলা বিশেষজ্ঞ নয়। নাক বিশেষজ্ঞ নয়। হাত-পা বিশেষজ্ঞ নয়। এই নফস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চারটা কাজ কর। যথা-

১. قِلَّةُ الطَّعَامِ| খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে ফেল। খাবার পেটের তিন ভাগের এক ভাগ গ্রহণ করা সুন্নত। খাবার কমিয়ে ফেললে দুনিয়ারও লাভ, আখেরাতেরও লাভ। খাবার যখন কম খাবে অলসতা আসবে না, ইবাদত সহজ হবে, বিভিন্ন রোগও থেকে মুক্ত থাকবে। বেশি খেলে রোগ হয়? না কম খেলে রোগ হয়? যত রকমের রোগ আছে, সবই বেশি খাওয়ার কারণে। কলেরা বেশি খাওয়ার কারণে। ডায়বেটিস বেশি খাওয়ার কারণে। গ্যাস্টিক বেশি খাওয়ার কারণে। যদি খাবার কম খান যাবতীয় রোগ হতে মুক্ত থাকবেন। এতে নফসও দমন হবে।

২. قِلَّةُ الْـمَنَامِ ঘুম কম যাও। ইশারের পরে শুয়ে যাওয়া এবং শেষরাত্রে উঠে যাওয়া। ঘুম বেশি গেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়। ব্লাড সারকোলেশন ঠিক থাকে না। ঠিক পরিমাণ ঘুম গেলে ব্লাড সারকোলেশন ঠিক থাকে শরীরে। আমাদের বাংলাদেশিরা অনেকে সকালে আটটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে।

দৈনিক কতক্ষণ ঘুমাবে? ডাক্তাররা বলছেন, ছয় ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট। ইশার নামাযের পর শুয়ে যাবেন। শেষরাত্রে উঠে যাবেন। ছয় ঘণ্টা ঘুম হয়ে যাবে। দুনিয়া তো জাগ্রত থাকার জায়গা। ঘুমের তো স্পেশাল জায়গা আছে কবর, কিয়ামত পর্যন্ত। এত ঘুমানোর ব্যবস্থা সেখানে। আবার সেখানে মশা নেই। আল্লাহঅলাদের জন্য বেহেস্তী বিছানা থাকবে, বেহেস্তী পোষাক থাকবে, বেহেস্তের দিকে দরজা খোলে দেওয়া হবে আল-হামদু লিল্লাহ। যারা আল্লাহঅলা নয়, তাদের জন্য কবরে সাপ থাকবে।

৩. قِلَّةُ الْكَلَامِ কথা কমান। জরুরি কথা বলবেন। বেহুদা কথা বলবেন না। এখন অনেকে বসে বসে গল্প করে। আমেরিকার এই অবস্থা, ওবামার এই অবস্থা, সরকারি দলের এই অবস্থা, বিরোধী দলের এই অবস্থা। নিজের অবস্থার খবর নেই। নিজের কী অবস্থা? আমি যে, কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হব। আমি ঈমানদার হিসেবে যাব? না বেঈমান হিসেবে যাব? খবর নেই। কথা কমান।

৪. قِلَّةُ اخْتِلَاطِ مَعَ الْأَنَامِ মানুষের সাথে মেলা-মেশা কমিয়ে ফেলুন। জরুরত হলে মেলা-মেশা করবেন।

এই চারটা কাজ দ্বারা নফসে আম্মারা দুর্বল হয়। নফসে আম্মারার যখন চিকিৎসা হবে, তখন নফসে আম্মারার নাম বদলে যাবে। তখন হবে নফসে লওয়ামা। লওয়ামা মানে হল, গালিদাতা নফস। তখন নফস বলবে, নামায কেন পড়নি? রোযা কেন রাখনি? সবসময় গালি দেয়। নফসে আম্মারার সাথে জিহাদ করতে হয়।

أَشَدُّ الْـجِهَادِ جِهَادُ الْـهَوَىٰ … وَمَا كَرَمُ الْـمَرْءِ إلَّا التُّقَىٰ

সবচেয়ে বড় জিহাদ হল, নফসের সাথে জিহাদ করা।

হাজী ইউনুস (রহ.)-এর একটি ঘটনা

হাজী ইউনুস সাহেব (রহ.)-এর সাথে আমি সফর করতাম। তিনি দীর্ঘদিন সফরের পর একদিন আমাকে বলেছেন, ‘আমি নফসের সাথে অনেক লড়াই করেছি।’ আমি বললাম, হুযুর! কী রকম লড়াই? হুযুর বললেন, ‘আমি স্ট্যান্ডার করে পান খেতাম। এত বড় মুরাদাবাদী পানের বাটা ছিল। সেখানে জর্দা রখার ঘর আছে তিনটা। তিন রকমের জর্দা থাকবে। পান বানিয়ে সবখান থেকে একটু একটু দিয়ে খাব। পান খাওয়ার পর খুশব বের হবে। কিছু দিন খাওয়ার পর নফসকে বললাম, হে নফস! তোমার বিলাসিতা বেড়ে গেছে। জর্দা খাওয়া দূরের কথা। তোমাকে আর পানও খাওয়াব না। জর্দা, পান-সুপারি, চুনা সবগুলো একত্রে নিয়ে পিতলের মুরাদাবাদী বাট্টা একটা বড় দিঘির মাঝে ছুড়ে মেরেছি। এরপর থেকে কেউ দিলে খাই। না পেলে কোনো অসুবিধা হয় না।’ হুযুর যা বলছেন তা বলছি, আমার পক্ষ থেকে নয়।

হুযুরের সাথে সৌদি আরবের এক শহরে গিয়েছিলাম। ভক্তরা হুযুরের জন্য অনেক পান হাদিয়া আনে। হুযুর এসব বালিশের নিচে রাখেন। ওখান থেকে মাঝে মাঝে খান। একদিন সব পান ফুরিয়ে গেল। আমি বললাম, হুযুর! পান কিনে আনি? তিনি বললেন, ‘না। পেলে খাব। না পেলে খাব না। আমার কোন অসুবিধা নেই। আমি নফসকে এমনভাবে কন্ট্রোল করেছি। কোন জিনিসকে অভ্যাস বানাইনি।’

হাজী সাহেব (রহ.)-এর নফসের সাথে জিহাদ

হাজী সাহেব হুযুর (রহ.) বলেন, ‘দেখ! এক যমানায় আমি সে যামানার খুব দামি কাপড় আবদি কাপড় গায়ে দিতাম। খুব ভালো লাগত। একদিন নফসকে বললাম, হে নফস! তুমি সব সময় আবদি কাপড় গায়ে দাও। তুমি বিলাসী হয়ে গেছ। এসব বাদ দিয়ে মার্কিন কাপড় সিলাই করেছি। মার্কিন কাপড় কিছুদিন গায়ে দেওয়ার পর নফস বলছে, তুমি তো এখন বুযুর্গ হয়ে গেছ। এখন নফস উল্টা ধোঁকা দিচ্ছ। নফস যখন আমাকে ধোঁকা দিল, তখন মার্কিন কাপড় বাদ দিয়ে আবার পাতলা কাপড় সিলাই করেছি। আবার যখন সেটা ধোঁকা দিচ্ছে, মার্কিন কাপড় বানিেিছ।’ আসলে তাঁরা এমনিতে বুযুর্গ হননি। অনেক জিহাদ করেছেন। আল্লাহু আকবর।

আশরাফ আলী থানবী (রহ.)-এর খোদাভীতি

হযরত আল্লামা আশরফ আলী থানবী (রহ.) বয়ান করছিলেন। এত সুন্দর বয়ান করছিলেন যে, বয়ান শুনে পাবলিকের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে বলল, ‘হুযুর আপনি এত সুন্দর বয়ান করেন। আপনি এত বড় আলেম কীভাবে হলেন? এত বড় বুযুর্গ কীভাবে হলেন?’ থানবী (রহ.) সাথে সাথে উত্তর দিলেন, ‘আমি আশরফ আলী থানবীর কিছু নেই। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) আমার দিকে তাওয়ায্‌যু দান করেছেন। সে জন্য আমার বয়ান তোমার ভাল লাগে।’ তাওয়ায্‌যু কার? হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)-এর। সে জন্য আমরাও বলি, বুযুর্গরা ইন্তিকাল করার পরেও তাদের রুহানি তাওয়ায্‌যু চালু থাকে।

পটিয়া মাদরাসার পুরাতন মসজিদ ভেঙে নতুন মসজিদ করবেন হাজী ইউনুস (রহ.)। সংকুলান হচ্ছে না। তখন ছাত্র বেড়ে গেছে। অনেকে আপত্তি করেছেন। বললেন, এটি মুফতী সাহেব হুযুর বানিয়েছেন। হাজী সাহেব ভেঙে ফেলেন। হুযুর সে দিন বলেছিলেন, ‘দেখ! আমি মুফতী সাহেব হুযুরের জীবদ্দশায় তাঁর হুকুম মতে সব কাজ করেছি। এখনও আমি হুযুরের থেকে জিজ্ঞেস করে করে কাজ করি। হুযুর তো কবরে। রুহানী তাআল্লুক আর সম্পর্ক। আত্মার সম্পর্ক। আল্লাহঅলারা রুহানী তাওয়ায্‌যু দিতে থাকেন।

বড় পীর শায়খ আবদুল কাদের জীলানী (রহ.)-এর ঘটনা

বড় পীর সাহেব খাজা আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) একদিন তাহাজ্জুদের পরে মুরাকাবায় বসেছেন। বুযুর্গরা প্রতিদিন মুহাসাবা করেন। সারা দিন আমি ভালো কাজ করলাম না খারাপ কাজ করলাম? আগামী কাল কী করব? অডিট। মাসিক অডিট নায়, ডেলি অডিট। আমি ভালো কাজ কয়টা করেছি? খারাপ কাজ কয়টা করেছি। আল্লাহর হাবিব (সা.) বলেন,

«حَاسِبُوْا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُحَاسَبُوْا وَزِنُوْا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُوْزَنُوْا».

‘আল্লাহর কাছে তোমার অডিট দেওয়ার আগে তোমাকে তুমি নিজে অডিট কর। তোমার হিসাব তুমি 
কর। তোমার আমল ওযন হওয়ার আগে তুমি মেফে দেখ তোমার কী পরিমাণ আমল আছে? নেকী কী পরিমাণ আছে? গোনাহ কী পরিমাণ আছে? এখন থেকে প্রস্তুত হও।’[১]

বড় পীর সাহেব মুরাকাবায় বসেছেন। নিজের হিসাব-কিতাব নিচ্ছেন। ধ্যানে বসেছেন। ওই অবস্থায় দেখেছেন, আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে একটা আওয়াজ এলো। আবদুল কাদের! আজ থেকে দু’শত আড়াই শত বছর পরে হিন্দুস্থানে একজন লোক জন্মলাভ করবে। তিনি বিদআতকে মিঠিয়ে দেবেন। সুন্নতকে জিন্দা করবেন। তোমাকে জানিয়ে দিলাম। খাজা আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) মুরাকাবা শেষ করার পরে খাদেমকে ডেকে বললেন, আমার জোব্বাটা নিয়ে আস। তাঁর একটি আরবি জোব্বা ছিল। এই জোব্বাটার দিকে তিনি তাওয়ায্‌যু দিলেন। অন্তরের দৃষ্টি দিলেন। চোখের দৃষ্টি না নয়। কচ্ছপ ছিনেন না? কচ্ছপ কোলে ডিম পাড়ে। ডিমের দিকে তাওয়ায্‌যু দেয় পানির ভেতর বসে। এমন তাওয়ায্‌যু দেয় যে, ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে যায়। কচ্ছপের তাওয়ায্‌যু দ্বারা যদি ডিম ফুটতে পারে। তাহলে আল্লাহঅলাদের তাওয়ায্‌যু দ্বারা আমাদের মাঝে ঈমান ফুটতে পারবে না কেন?

বড় পীর সাহেব জোব্বার দিকে তাওয়ায্‌যু দিলেন। খাদেমকে বললেন, এই জোব্বাটি তোমার কাছে রাখ। তুমি মারা গেলে তোমার পরবর্তী লোককে দেবে। সে মারা গেলে পরবর্তী লোককে দেবে। এভাবে করতে করতে আড়াই শত বছর পরে হিন্দুস্থানে একজন লোক বের হবেন। তাঁর কাছে আমার এ জোব্বাটি পৌঁছে দিলে আমার এ জোব্বাটি তার কাছে পৌঁছুবে। আড়াই শত বছর আগে তাওয়ায্‌যু দিলেন বড় পীর সাহেব (রহ.)। এ জোব্বাটি আড়াই শত বছর পরে শেষ পর্যন্ত পৌঁছুল বাগদাদের শাহ কামাল (রহ.)-এর কাছে। তিনিও যামানার বড় বুযুর্গ। সে সময় মুজাদ্দিদে আলফে সানী সাইয়েদ আহমদ সরহিন্দী (রহ.) জন্ম লাভ করেছেন। যিনি সম্রাট আকবর আর সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মুকাবেলা করেছেন।

বড় পীর সাহেব (রহ.) শাহ কামালকে স্বপ্ন দেখলেন, আমার জোব্বাটি মুজাদ্দিদ সাহেব (রহ.)-কে দিয়ে দিও। শাহ কামাল দেননি। কারণ বরকতময় জিনিস তো। তিনি মনে করলেন, আর কিছু দিন থাকুক বরকত বেশি পাব। সে জন্যে দেননি। যখন দেননি, বড় পীর সাহেব (রহ.) আরেকদিন স্বপ্ন দেখালেন। দেখ! তাড়াতাড়ি জোব্বাটি দিয়ে দাও। যদি না দাও তোমার বুযুর্গি যা আছে তাও চলে যাবে। শাহ কামাল (রহ.) জোব্বা নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে হিন্দুস্থানে আসলেন। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর বাড়ির মসজিদে ফজরের নামায পড়লেন। নামায শেষ করে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে জোব্বাটি দিয়ে বললেন, হুযুর এই জোব্বাটি আপনার জন্য হাদিয়া। মুজাদ্দিদ সাহেব (রহ.) বললেন, কে হাদিয়া দিছে? শাহ কামাল বললেন বড় পীর সাহেব (রহ.)-এর হাদিয়া। মুজাদ্দিদ সাহেব (রহ.) সাথে সাথে জোব্বাটি গায়ে দিলেন। এতো মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর উন্নতি আরম্ভ হয়ে গেছে।

শেষ পর্যন্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে সংঘর্ষ শুরু হল। সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন শিরক শুরু করল। তার দরবারে গেলে রুকু করতে হয়। মুজাদ্দিদ সাহেব (রহ.) ভাবলেন, কোন মানুষের সামনে সাজদাও করা যায় না, রুকুও করা যায় না। এটা হারাম। শিরক। এই শিরকের বিরুদ্ধে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) জিহাদ ঘোষণা করলেন। তখন জাহাঙ্গীরের রাজদরবারে তখন কিছু নামধারী মৌলভী ছিল। তারা বারবার বাদশাহর কানে কানে বলল, হুযুর! শুনেননি? মুজাদ্দিদে আলফে সানী আপনার হুকুমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বারবার বলে। জাহাঙ্গীর বাদশাহ এসব কানে নেন না। শেষপর্যন্ত একদিন জাহাঙ্গীর বাদশাহ পুলিশ ডেকে বললেন, ‘মুজাদ্দিদকে গ্রেফতার করে নিয়ে আস।’ গ্রেফতার করতে গেল। মুজাদ্দিদকে তারা চিনে। তারা বলল, হুযুর! বাদশাহ আপানাকে যেতে বলছেন। গ্রেফতার করেনি। হুযুর তো বুঝতে পেরেছেন। তিনি একটি লাঠি, একটা পাগড়ি, একটি মিসওয়াক এবং একটা লোটা নিয়ে বের হলেন। এই লোটা হল মুসলমানের হাতিয়ার। এই লোটার পানি দিয়ে অযু করে নামাযে দাঁড়ালে সমস্ত বাতিল শক্তি মিসমার হয়ে যায়।

আল্লাহর ভয় যার কাছে আছে তাঁকে কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) খাদেমকে সাথে নিলেন। অযু করার লোটা ও মিসওয়াক সাথে নিলেন। এটিও হাতিয়ার। এক যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম যুদ্ধ করছিলেন। দেখা গেল, সাহাবীর সংখ্যাও বেশি কিন্তুযুদ্ধ করে জয় লাভ করতে পারলেন না। আমির সাহেব পরামর্শ করলেন, দেখ তো! কোনো সুন্নত আমরা বাদ দিয়েছি কিনা? দেখা গেল মিসওয়াকের সুন্নতটি এক সপ্তাহ যাবৎ বাদ দেওয়া হয়েছে। মিসওয়াক করতে পারেননি। আমির সাহেব বললেন, এই কারণে আমরা জয়ী হতে পারছি না। তোমরা আগামী কাল সকালে সকলে একসাথে দাঁড়িয়ে মিসওয়াক করবে। সকাল বেলা যখন একসাথে সকলে দাঁড়িয়ে মিসওয়াক আরম্ভ করে দিলেন। কাফেরদের ক্যাম্প ওদিকে সামনে। ওরা ক্যাম্প থেকে দেখছে। একজন আরেকজনকে বলছে, মুসলমান তো আজকে খুব রাগের মধ্যে আছে দেখা যায়। ওরা দাঁত যেভাবে ধার করছে। আমাদের তো আজকে চাবিয়ে চাবিয়ে খেয়ে ফেলবে। অতঃপর শত্রুরা সব পালিয়ে গেল। মিসওয়াকের সুন্নতের ওপর আমল করার কারণে।

রসুল (সা.)-এর প্রত্যেকটা সুন্নতে বিজ্ঞান আছে। মিসওয়াক সম্পর্র্কে আছে মিসওয়াকে ৭০টি ফায়েদা আছে। সর্বশেষ ফায়েদা হচ্ছে মৃত্যুর সময় কালেমা নসিব হবে। আল-হামদুলিল্লাহ।

মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) একটি মিসওয়াক, একটি বদনা, একটি পাগড়ি, আরেকটি লাঠি; এসব নিয়ে জাহাঙ্গীর বাদশাহর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। দেখলেন, সামনে একটি গেইট আছে রুকু করে যেতে হয়। গেইটটি এত নিচু করে করা হয়েছে যে, মানুষ রুকু করতে বাধ্য। বাদশাহকে রুকু করে সেখানে ঢুকতে হয়। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বললেন, গেইটটি ভেঙে ফেলুন। বাদশাহর কাছে যদি আমার যেতে হয়। তাহলে গেইট ভেঙে ফেলুন। জাহাঙ্গীর বাদশাহ বিক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন। বললেন, ‘রাজ-দরবারের মান-সম্মানের প্রশ্ন, রুকু করে আসতে হবে, সেটি আগে করুন।’ মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) মাথা নত করবেন না। কারণ এই ঘাড়ের ওপর তাওহীদের তেল মালিশ করা আছে। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বললেন, ‘তোমার লজ্জা লাগে না? আমি তো সাজদা করব আল্লাহকে। তোমার কাছে আমি কেন সাজদা করব? তুমি ভাত খাও। তুমি পেশাব কর। তুমি পায়খানা কর। তোমার মতো মানুষের সামনে আমি কেন মাথানত করব?’ বাদশাহ বিক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন। বাদশাহ বললেন, ‘জল্লাদ! এই মওলানা সাহেবকে নিয়ে যাও। এতো হেফাযতে ইসলাম করে। সে জামানার হেফাযতে ইসলাম আর কি?’

জল্লাদ লাল কাপড় গায়ে দিয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে নিয়ে যাচ্ছে। আর তিনি মুচকি মুচকি হাসছেন। কারণ তিনি জানেন, হায়াতের মালিক আল্লাহ। মওতের মালিক আল্লাহ। জাহাঙ্গীর বাদশাহর কোনো ক্ষমতা নেই আমাকে মারার।

জল্লাদ মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে নিয়ে যাচ্ছে। এখন তাঁকে হত্যা করবে। ইতিহাসে লেখা আছে, আল্লাহ তো সাথে আছেন। আর যে অর্ডার করেছে তার সামনে শয়তান আছে। জাহাঙ্গীর বাদশাহ বসা। তার সামনে টেলিফোনের মতো রিং আসছে। হে জাহাঙ্গীর! কাকে কতল করছ? এই মুজাদ্দিদকে যদি কতল কর তোমার রাজ্য তছনছ হয়ে যাবে। বাদশাহ ভয় পেয়ে গেল। শাস্তি কমিয়ে দিয়েনেছ। জেলখানায় রেখেছেন। মুজাদ্দিদ (রহ.) জেলখানায় গিয়ে দেখে সব চোর। ভালো লোক কি জেলখানায় যায়? চোর হয়ে ডুকে ডাকাত হয়ে বের হয়। কিন্তু কিছু কিছু আল্লাহঅলাও দেখা যায়। খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দীক আহমদ (রহ.)-কে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জেলখানায় রাখা হয়েছিল। তিনি প্রত্যেক দিন সেখানে নামায পড়াতেন। ওয়ায-নসীহত করতেন। চোর সব ভালো লোক হয়ে গেছে।

মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) সেখানে গিয়ে দেখলেন, কামরায় কামরায় সব চোর। তাঁকে একটি কামরায় রাখা হয়েছে। শেষরাত্রে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার পর যখন ফজর শুরু হল, তিনি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আযান আরম্ভ করে দেন। এটি শয়তানের জন্য এটম বোম। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) আযান দেওয়ার পরে প্রত্যেকের রুমে রুমে গিয়ে বললেন, উঠ! উঠ! কেউ উঠে না। একজন দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল, বলেন কী? মুজাদ্দিদ সাহেব বললেন, নামায পড়ার জন্য ডাকছি। যে আল্লাহ আসমান-জমিন, হায়াত-মওতের মালিক। সে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামায পড়ার জন্য আযান দেওয়া হয়েছে। কেউ আসে না। অনেক দিন আযান দেওয়ার পর একজন বলল, হুযুর আপনি তো একা। আমি আপনার সাথে নামায পড়ব। আমি আপনার পার্টিতে শরীক হব। এটি মুসল্লি পার্টি। এমনিতে তো এক পার্টিতে আরেক পার্টি নেই। কিন্তু মুসল্লি পর্টিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ-বাসদ সব পার্টির লোক আছে কিনা? মুসল্লি পার্টির প্রেসিডেন্ট হল ইমাম সাহেব। সেক্রেটারি হল মুযায্‌যিন সাহেব। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) সেই মুসল্লিকে বলল, আমি ইমাম তুমি মুয়ায্‌যিন। দুই সদস্য বিশিষ্ট পার্টি। আযান দেওয়া আরম্ভ হয়েছে। কিছুদিন পর আরেকজন এসেছে। এভাবে পুরো জেলখানার সব মুসল্লি হয়ে গেল। এটি আসলে আল্লাহ পাকের মরজি। আল্লাহ পাক জেলখানার লোকগুলোকে হেদায়ত করার জন্য মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে সেখানে ডুকিয়েছেন। তাঁর কাছে মুরিদ হয়ে প্রত্যেকটি লোক আল্লাহঅলা হয়েছেন। যখন সব লোক মুসল্লি হয়ে গেল, এখন মুজাদ্দিদে আলফো সানী (রহ.)-এর কাজ শেষ। যে কাজের জন্য আল্লাহ পাক পাঠিয়েছেন, সে কাজ শেষ।

এ দিকে জাহাঙ্গীর বাদশাহ রুমে শুয়ে আছেন। স্বপ্নে দেখছেন, দিল্লীর জমে মসজিদের সামনে একটা হাউজ। সেই হাউজে বসে রসুল (সা.) অযু করছেন। জাহাঙ্গীর বাদশাহ পেছনে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। রসুল (সা.) উত্তর দেননি। আরেক দিকে গিয়ে আবার সালাম দিলেন। রসুল (সা.) কোনো উত্তর দেননি। অযু করে যখন হুযুর (সা.) দাঁড়িয়েছেন। আবার সালাম দিলেন। রসুল (সা.) উত্তর দেননি। জাহাঙ্গীর বাদশাহ বললেন, হুযুর আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট কেন? রসুলে আকরাম (সা.) বললেন, আমার একটি কুকুর তুমি বেঁধে রেখেছ। কেন তোমার সালামের উত্তর দেব? তাঁকে ছেড়ে দাও। না হয় তোমার রাজত্ব থাকবে না। ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে একাএকা বেরিয়ে গেলেন। সাথে কেউ নেই। অথচ দিল্লীর বাদশাহ যখন বের হন, আগে পরে কয়েক শত পুলিশ থাকে। আজকে গার্ডও নেই। পায়ে জুতাও নেই। সরাসরি জেলখানায় চলে গেলেন। লোকেরা সরে যাচ্ছে। ওরা মনে করছে, বোধ হয় বাদশাহর ব্রেইন নষ্ট হয়ে গেছে। আসলে ব্রেইন ঠিক আছে। প্রহরী জিজ্ঞেস করল, আপনি কেন এসেছেন? বাদশাহ বললেন, জেলখানার গেইট খোল। মুজাদ্দিদে আলফে সানী কোথায় আছেন? আমাকে সেখানে নিয়ে যাও। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর রুমে গিয়ে দেখেন তিনি তাহাজ্জুদ নামায পড়ছেন, সাজদায় আছেন। এই তাহাজ্জুদের নামাযের ধক্কা লেগেছে রাজ-দরবারে। আল্লাহ পাক বলেন,

رَبُّ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِيْلًا ۰۰۹

বাদশাহ বসে আছেন। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) নামায পড়ে দুআ করে বসছেন। বাদশাহ পায়ের ওপর পড়ে গেলেন। বললেন, হুযুর! আমাকে মাফ করে দিন। আপনাকে গ্রেফতার করার কারণে আল্লাহর রসুল আমার সালামের উত্তর দেননি। আমি আপনাকে মুক্তি দান করলাম। আজ থেকে আপনি মুক্ত। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বললেন, শুধু আমাকে মুক্তি দান করলে হবে না। এখানে যত লোক আছে সব অলী আল্লাহ হয়ে গেছেন। এদেরকেও মুক্তি দিতে হবে। শধু তাই নয়, বাদশাহ আকবর যে দিনে ইলাহী আবিষ্কার করেছেন। সেটা ক্যান্সেল করতে হবে। জাহাঙ্গীর বাদশাহ বললেন, হুযুর! আপনার সামনে ঘোষণা করলাম, আজ থেকে সেই ধর্ম ক্যান্সেল। আমার রাজ-দরবারে আর রুকু করতে হবে না। তারপর দিন সকালে জাহাঙ্গীর বাদশাহ শাহজাহানকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাদশাহ বললেন, শাহজাহান! তুমি গিয়ে কয়েক শত পুলিশ নিয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানীকে আমার রাজ-দরবারে নিয়ে এস এবং জেলখানায় যত বন্দী আছে সবাইকে জেলখানা হতে মুক্ত করে দাও। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে রাজ-দরবারে নিয়ে আসার পর বাদশাহ নিজ পুত্র শাহজাহানকে বললেন, শাহজাহান! তুমি হুযুরের কাছে মুরিদ হয়ে যাও। আমিও মুরিদ হব। জাহাঙ্গীর বাদশাহও মুরিদ হয়ে গেলেন। তখন যুদ্ধ চলছিল। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে একটা পালকিতে বসিয়ে যুদ্ধে নিয়ে গেলেন। তখন গাড়ি ছিল না। মুজাদ্দিদ সহেব (রহ.)-কে একটি রুমে রাখা হল। বাদশাহ সারাদিন যুদ্ধ করেন। শেষরাত্রে এসে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর পা টিপেন।

মসজিদে নববীতে রসুল (সা.) একটা শুকনা খেজুর গাছের সাথে ঠেক লাগিয়ে খুতবা দিতেন। তখন মিম্বর তৈরি হয়নি। যখন মিম্বর তৈরি হল, রসুল (সা.) মিম্বর খুতবা দিতে উঠলেন। কোথা হতে কান্নার আওয়াজ আসে। কে কাঁদছে? রসুল (সা.) খুতবা বন্ধ করে দিলেন। এদিক সেদিক তাকান। কারো চোখে কান্না দেখা যায় না। দেখা যায় খেজুর গাছ হতে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে।

হুযুর (সা.) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন কাঁদছ? খেজুর গাছ বলে, এতদিন মিম্বর ছিল না। আমার শরীরের সাথে আপনার শরীর লাগতো। আমি আনন্দ ভোগ করতাম। এখন মিম্বর তৈরি হয়েছে। আমাকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। বিয়োগ-ব্যথায় কাঁদছি। রসুল (সা.) বললেন, ‘দেখ! তোমাকে পুরষ্কার দেব, মুহাব্বতের বদলা। তোমাকে দুটি প্রস্তাব দেব। যথা- ১. এখান থেকে উঠিয়ে তোমাকে আমি একটি জায়গায় লাগাব। তুমি তাজা হয়ে যাবে। কিয়মত পর্যন্ত খেজুর ধরবে। ২. তোমাকে এখান থেকে উঠিয়ে মানুষের মতো মাটিতে দাফন করব। আমি যখন বেহেস্তে যাব। তোমাকে বগলের নিচে নিয়ে বেহেস্তে চলে যাব। তুমি কোনটা করবে বল। খেজুর গাছ বলল, হুযুর! বগলের নিচে করে বেহেস্তে যেতে চাই।

খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ সাহেব (রহ.) বলেছেন, আল্লাহ মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে দিয়ে জাহাঙ্গীর বাদশাহকে মুক্তি দান করেছেন। একদিন মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বলেছেন, জাহাঙ্গীর! আল্লাহ যদি আমাকে বেহেস্ত দান করে। তোমাকেও সাথে নিয়ে যাব। জাহাঙ্গীর আল্লাহর অলী হয়ে গেছেন না?

আমি যখন টাঙ্গাইলে ছিলাম। আমি এক মসজিদে নামায পড়াতাম। সাইন্সের এক প্রফেসর। লোকটি নামাযী। তিনি প্রত্যেক দিন আমাকে একটি করে প্রশ্ন করেন। বিজ্ঞানভিত্তিক। একদিন বললেন, হুযুর! অযুর ফরয কয়টি? আমি বললাম, চারটি। তিনি বললেন, কুলি করা, নাকে পানি দেওয়া, শুরুতে হাত ধোয়া এসব তো কুরআনে নেই। এসব কেন করেন? যুক্তি দিয়ে বোঝান। আমি বললাম, কুরআনে আছে। সে বললেন, কই? দেখা যায় না। আমি বললাম, অনেক জিনিস থাকলেও দেখা যায় না। আপনার পেটের ভেতর নাড়ি-বুড়ি আছে না? তিনি বললেন, আছে তো। আমি বললাম, দেখা যায়? তিনি বললেন, না। মাঝে মাঝে অফারেশন করলে দেখা যায়। আমি বললাম, কুরআন শরীফেও অফারেশন করলে এগুলো দেখা যাবে। অপারেশন মানে, তফসীর। তিনি বললেন, কেমন? আমি বললাম, আল্লাহ পাক বলেছেন,

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا قُمْتُمْ اِلَى الصَّلٰوةِ فَاغْسِلُوْا وُجُوْهَكُمْ وَاَيْدِيَكُمْ اِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوْا بِرُءُوْسِكُمْ وَاَرْجُلَكُمْ اِلَى الْكَعْبَيْنِؕ ۰۰۶ {المائدة}

তোমরা যখন নামায পড়ার ইচ্ছা কর, প্রথমে চেহারা ধোয়ে নেবে। এখন ওই পানি তরল কিনা? পাক কিনা সেটি দেখতে হবে না? এখন যদি একজন অন্ধ মানুষ মনে করে সে কীভাবে বুঝবে বরফ না পানি? যদি ভেতরে হাত ডুকে যায়, তাহলে পানি, আর না হয় বরফ। এ জন্য প্রথমে দু’হাত ধোয়ে নিতে হয়। দ্বিতীয় তরল তো বুঝলাম, ডালও তো তরল। এটি তো ডালও হতে পারে। তাই একটু মেখে দিয়ে টেস্ট করতে হয়। ডাল না পানি? তৃতীয় এখন বুঝলাম, এটি পানি। এখন এখানে নাপাক পড়ছে কিনা? নাপাক পড়লে তো দুর্গন্ধ হয়ে যায়। তাই একবার নয়, তিনবার নাকে দিয়ে এটাকে টেস্ট করতে হয়। যখন বুঝলেন, এটা পানি, এটা বরফ নয়, এটা ডাল নয়, আবার নাপাকও নয় এবার আপনি অযু করতে পারেন।

আমি বললাম, আপনি তো বিজ্ঞানের প্রফেসর। আপনার লাইনে আমি একটু প্রশ্ন করি। তিনি বললেন, কী? আমি বললাম, কালোর সাথে কালো মিশলে কী হবে? তিনি বললেন, কালো বাড়বে। আমি বললাম, সিলেট কালো, পেন্সিলও কালো, কাল পেন্সিল দিয়ে সিলেটে লিখলে সাদা কেন বের হয়? আমি বললাম, লাল আর সাদা মিশ্রিত হলে কী রকম হবে? তিনি বললেন, গোলাপী হবে। আমি বললাম, লাল আগুন দিয়ে সাদা কাগজ জ্বালালে ছাইগুলো গোলাপী হওয়া দরকার ছিল। কালো কেন হয়? তিনি বললেন, আমি এসব বুঝি না। বোঝা এখনও শেষ নয়। কুরআনী বিজ্ঞান যার কাছে আছে, আর আমেরিকান বিজ্ঞান যার কাছে আছে, তাদের মধ্যে আসমান-জমিন ব্যবধান।

এই যে, জাহাঙ্গীরের কথা বলছিলাম। তাঁর পিতার নাম হল আকবর। আকবরের দরবারে কিছু মওলানা সাহেব রেখেছিলেন। আর কিছু হিন্দু পণ্ডিতও রেখেছেন। মওলানা ছিলেন মোল্লা দুফইয়াদা। তিনি ভালো লোক ছিলেন। আজে-বাজে কথা বন্ধ করার বন্য চেষ্টা করতেন। মোল্লা দুফইয়াদা একদিন বাদশাহকে বললেন, বাদশাহ সাহেব! তিনটা জিদ খুব প্রসিদ্ধ। যথা- ১. ঘোড়ার জেদ। ঘোড়া যখন জেদ ধরে, তখন মালিককে কাঁটা বনে গিয়ে ফেলে। ২. স্ত্রীর জেদ। সে যখন বাপের বাড়ি যেতে চায়। স্বামী যদি না নিয়ে যায়, পাক ঘরে গিয়ে কান্নাকাটি আরম্ভ করে। বলে, সারা জীবন আমাকে এরকম রাখে। এ ঘরে একদিনও আমি সুখ পায়নি। কথায় আছে, রাজার রাজ্য শাসন আর রানির রাজা শাসন। ৩. ছোট ছেলের জেদ। বাদশাহ বলে এটি কেমন? ছোট ছেলে যা চায় তা দিলে তো তার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, এত সহজ নয়। না হয় পরীক্ষা করুন। কিছুক্ষণের জন্য আপনি পিতা হন। আমি ছেলে হবো। আপনি চেয়ারে বসেন। আমি ছেলে হয়ে নিচে বসে থাকি। বাদশাহ বললেন, আচ্ছা! ঠিক আছে। বাদশাহ আকবর বসা। মোল্লা দুফইয়াদা নিচে বসা। বাদশাহ বললে, কি চাও? মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, আমি মিটায় খাব। এনে দিলেন। আবার কাঁদে। বাদশাহ বললেন, আর কী চাও? মোল্লা বললেন, মিষ্টি খাব। আবার কাঁদে। বাদশাহ বললেন, এখনও কেন কাঁদ? মোল্লা বললেন, আমাকে একটা হাড়ি এনে দিন। বাদশাহ এনে দিল। আবার কাঁদে। বাদশাহ বললেন, এখনও কেন কাঁদ? মোল্লা বললেন, আমাকে একটি হাতি দিতে হবে। বাদশাহর রাজদরবার থেকে একটি হাতি এনে দিলেন। আবার কাঁদে। বাদশাহ বললেন, এখনও কেন কাঁদ। মোল্লা বললেন, হাতিটা পাতিলের ভেতর ভরে দিন। এখন আর পারে না। মোল্লা ভরে দেন ভরে দেন বলে কাঁদছে। কাঁদা আর বন্ধ হয় না।

মোল্লা দুফইয়াদা এবার বাদশাহকে বললেন, আমি বলছিলাম না ছোট ছেলের জেদ। তাদের কান্না থামা যায় না। বাদশাহ স্বীকার করলেন। মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, আপনার মাথায় কুরআন নেই। সে জন্য আটকে পড়েছেন। আমি যদি পিতা হতাম আর আপনি যদি ছেলে হতেন। যা চান তা দিতাম। কারণ আমার ভেতরে কুরআন আছে। কুরআনের দাম বোঝাচ্ছেন। বদশাহ বললেন, ঠিক আছে আপনি কিছুক্ষণের জন্য পিতা হন। আমি নিচে বসব। মোল্লা দুফইয়াদা এসে শাহী চেয়ারে বসে গেল। কুরআনের দাম বাড়িয়েছে আল্লাহ।

কুরআন কারো দাম বাড়ায়। কারো দাম কমায়। মোল্লা দুফইয়াদা যা যা বলছেন বাদশাহও তা বলছেন। বলতে বলতে বাদশাহ যখন বললেন, আমাকে একটা হাতি দেন। মোল্লা দুফইয়াদা একটি ছোট ছেলেদের খেলনার হাতি এনে দিলেন। এখন বাদশাহ হাতিটা পিতলে ভরে দেন আর বলে না। কারণ এটা তো পিতলে ডুকে যাবে। মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, দেখুন আপনি আমার কান্না থামাতে পারছিলেন না। বাদশাহ বললেন, আপনি এত ছোট হাতি কেন এনে দিয়েছেন? মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, বাচ্ছাদের হাতি কোনটা সেটা বুঝতে হবে না? এত বড় হাতি নিয়ে ছেলেরা খেলা করে? আপনি তো এখন বাচ্ছা, তাই আপনাকে ছোট হাতি এনে দিয়েছি। এজন্য মাদরাসার প্রয়োজন। ঈমানী বিজ্ঞান শিখার জন্য মাদরাসার প্রয়োজন। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাওফীক দিয়েছেন জলসায় আসার জন্য। আপনারা অনেকে কষ্ট করেছেন। ক্ষমা করে দেবেন এবং মাদরাসার জন্য দুআ করবেন। দেশের জন্য দুআ করবেন।