নোটিশ
আপনি কি ব্লগ কিংবা ফেসবুকে ইসলাম এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতে আগ্রহী?
তাহলে আপনার লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের ফেসবুক পেজে মেসেজ দিন। ধন্যবাদ

Saturday, November 18, 2017

সুলতান মা‘হমূদ (র‘হঃ)-এর সে গ্রাম্য সচিব যাকে সবাই অপছন্দ করতো (সত্যিই একটি শিক্ষনীয় এবং বাস্তব ঘটনা)!

মাওলানা রূমী (র‘হঃ) সুলতান মাহমূদ গজনবী এবং ‘আইয়ায এর তিনটি ঘটনা লিখেছেন। খুবই আশ্চর্যান্বিত ঘটনা লিখেছেন।


বলেন যে, সুলতান মা‘হমূদ একজন ন্যায়পরায়ন বাদশা বা প্রশাসক ছিলেন, তার কাছে একজন গ্রাম্য যুবক আসল যার সম্পর্ক শুধুই গ্রামের সাথে ছিল, শহরের চাল-চলন সম্পর্কে যার কিছুই জানা ছিল না। যার ছিল না কোন ‘ইলম-কালামও। কিন্তু বাদশাহ্‌র দরবারে এসে যখন খেদমতে লাগলো তখন সে এমন যত্নের সহিত খেদমত করলো যে, অল্প দিনের মধ্যেই বাদশাহ্‌র মন জয় করে নিল এবং বাদশাহ্‌র দৃষ্টিতে স্থান পেয়ে গেল। যার কারণে বাদশাহ্ তাকে তার বিশেষ লোকজনদের মধ্যে শামিল করে নিল।


প্রথম থেকে যারা বাদশাহ খুব কাছের ছিল তারা এ নিয়ে খুব ঈর্শ্বান্বিত হলো যে, আমরা নামি-দামি পরিবারের,শিক্ষিত, বুদ্ধিমানও, আমরা বাদশাহ্‌র বিশেষ লোকদের মধ্যে। মধ্যখানে এই অল্পবয়সী ‍গ্রাম্য যুবক কোত্থেকে আসলো এবং বাদশাহ্‌র দৃষ্টিতে বিশেষ স্থান করে নিল। তাই তারা চিন্তা-ভাবনা করলো যে, আমরা বাদশাহ্‌র সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব, কথা অনুযায়ী বাদশাহ্‌র সাথে তারা কথাও বলল যে, বাদশাহ সাহেব আজকালকের এই যুবককে আপনি আমাদের চেয়েও কিছু বেশিই গুরুত্ব দিচ্ছেন, ভালবাসছেন যা আমরা পাচ্ছিনা। অথচ ইলম,বুদ্ধি,ধন ইত্যাদিতে আমরা তার চেয়ে অনেক উর্দ্বে। 


বাদশাহ সাহেব বললেনঃ ঠিক আছে আমি কখনো সময় সাপেক্ষে এ কথার উত্তর দেব। অতঃপর বাদশাহ এক ধরনের ফল (যা খুবই তিতা খাওয়ার উপযোক্ত না) আনালেন এবং তা সুন্দরভাবে থালিতে সাঁঝিয়ে ঐ সকল লোকজনকে উপস্থিত করলেন যারা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন এবং ‘আইয়াযকেও ডকালেন, এবং ফলের থালিগুলি সবার সামনে উপস্থাপন করলেন। যখন ফল মুখে দিল সবাই থু থু করে ফল মুখ থেকে বের করে ফেলে দিল এবং বলতে লাগলো যে, বাদশাহ সাহেব! এ কি ফল? এটা তো খাওয়া যাবে না, ছি… ছিহ কিযে তিতা। এবার বাদশাহ আইয়াযের দিকে দৃষ্টি দিল, দেখলেন যে, সে খুব উৎফুল্লতার সহিত খাচ্ছে।

বাদশাহ তাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ আইয়ায! ফলটা কেমন লাগছে?

আইয়ায বললঃ ফলটা তো আসলে খুবই তিতা।

বাদশাহ বললেনঃ তাহলে এত উৎফুল্লতার সহিত খাচ্ছো যে?

আইয়ায বললঃ বাদশাহ সাহেব তিতা হয়েছে তো কি হয়েছে, যে বাদশাহ্‌র কাছ থেকে সারা জীবন মিষ্টি ও মজাদার ফল-ফলাদি খেয়ে আসছি, আজকে যদি একটা তিতা ফল দেয়া হয় তা কি ভাবে ফিরিয়ে দিতে পারি;

“যদি সাধারণ এ বিষয়টি আমাদের মধ্যে আসতো যে, সারাটি জীবন যে রব্বুল ‘আলামীন আমাকে আরাম-আয়েশে জীবন-যাপন করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, আজ যদি তার পক্ষ থেকে সামান্যটুকু পরিক্ষামূলক কিছু আসে, তখন কেন আমরা তার সমালোচনা করতে থাকি।”

২য় ঘটনা-
অতঃপর বাদশাহ চিন্তা করলেন যে, আমাকে এমন কোন হেকমত অবলম্বন করা চাই যেন আইয়াযের ব্যাপারে সমালোচনাকারীদের বিষয়টা বুঝে আসে। কথা অনুযায়ী বাদশাহ একদিন তাদের সবাইকে একত্রি করলেন এবং বললেন যে, দেখ আজ আমি তোমাদের সবার বুদ্ধি পরীক্ষা করবো, কে কতটুকু বুদ্ধিমান। দেখি এ পরীক্ষায় কে উত্তির্ণ হয়। যখন এ কথা বললেন সবাই বাদশাহ সাহেবের কথা শুনে সতর্ক হয়ে গেলেন।

বাদশাহ একটি বড় মাপের দামি হিরা আনালেন সাথে একটা হাতুড়ীও আনালেন এবং সকলকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন যে, তোমাদের পরীক্ষা হচ্ছে এই হিরাটাকে হাতুড়ী দ্বারা ভেঙ্গে ফেলা।

পরীক্ষা শুরু হলো, প্রথমজন এলো, হিরার কাছে গিয়ে চিন্তা করতে লাগলো যে, বাদশাহ সাহেব আমার বুদ্ধির পরীক্ষা করছে, এ চিন্তা করে সে বললঃ যে, বাদশাহ সাহেব! এ হিরাটা তো খুবউ উন্নতমানের এবং বেশদামী হিরা, যাতে কোন ক্ষুত নাই, এটা এত ক্রেটের ডায়মন্ড ইত্যাদি। এটা কি ভাবে ভাঙ্গতে পারি।

বাদশাহ সাহেব হেঁসে বললেনঃ আচ্ছা খুব ভাল কথা। এভাবে ক্রমান্বয়ে এক এক করে সবাইকে পরীক্ষা নেয়া হলো, সবাই তাদের যারা যার বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী একেকটা সুন্দর উত্তর দিয়ে হিরাটি ভাঙ্গা থেকে নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমান করতে বিরত থাকলো। আর তারা মনে মনে ভাবতে লাগলো যে, আমি বাদশাহ্‌র মন জয় করে নিয়েছি।

পরিশেষে বাদশাহ সাহেব আইয়াযকে ডাকালেন, আইয়ায এসেই সে মূল্যবান হিরাটি এক আঘাতেই টুকরা টুকরা করে দিল। আর এ অবস্থা দেখে অন্যান্যরা খুশিতে ভাবতে লাগলো যে, আজ এই গেওর নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ পেয়েছে; এ তো গ্রাম্য, গেও সে কি জানে যে, এ হিরাটি কত মূল্যবান ছিল, আর ভাবতে লাগলো যে, আজকে তো বাদশাহ তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে মহল থেকে বের করে দেবে। 

অতঃপর বাদশাহ সাহেব তাকে প্রশ্ন করলো যে, হে আইয়ায তুমি এত মূল্যবান হিরাটি ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে দিলে?

আইয়ায একটি সহজ সরল উত্তরদানে বলল যে, বাদশাহ সাহেব! আমার কাছে দু’টা পথ ছিল। এক, এ মূলবান হিরাটিকে মূলবান ভেবে না ভাঙ্গা, যেটা করলে আপনার হুকুম অমান্য হতো। দুই, হিরাটি মূল্যবান হলেও সেটার মূল্যর দিকে না দেখে আপনার হুকুম মান্য করা। আর আমার কাছে আপনার হুকুমের মূল্য এমন লক্ষ হিরার চেয়েও মূলবান, তাই এই অতিমূল্যবান হিরাটির মূল্য আপনার হুকুমের সামনে মূল্যহীন ভেবে ভেঙ্গে ফেলেছি, একমাত্র আপনার হুকুমের সম্মানার্থে। 

মাওলানা রূমী বলেনঃ
“ আইয়াযের মনে বাদশাহ্‌র হুকুমের প্রতি যতটুকু সম্মান ছিল, যদি আল্লাহ্‌র বান্দাদের মনে মহান রব্বুল ‘আলামীনের প্রতি এরকম সম্মান চলে আসতো; তাই আমাদের দরকার যে, আমরা আমাদের মনের ভাষনা, কামনা ইত্যাদির সবটুকুই ভেঙ্গে দেয়া, তথাপি কখনো আল্লাহ তা‘আলার হুকুম না ভাঙ্গা, অর্থাৎ তার হুকুম অমান্য না করা।”

তৃতীয় ঘটনা-
সে সমালোচনাকারীদের একজন এসে বাদশাহকে বললো যে, বাদশাহ সাহেব!

আমার মনে পূর্ণ সন্দেহ যে, আপনার এই ভালবাসার পাত্র আইয়ায আছে না, সে রাজভান্ডার থেকে আসবাবপত্র চুরি করে। বাদশাহ জিজ্ঞেস করলেন কি ভাবে? সে বলে যে, সে একটি আলমারি বানিয়েছে এবং উক্ত আলামরি সকাল সন্ধ্যা খুলে খুলে দেখে, দেখা হলে বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেয়, তালার চাবি সংরক্ষন করে রাখে এবং এ চাবি কারো কাছেই দেয় না। তাই বাদশাহ সাহেব! আমার শতভাগ সন্দেহ যে, সে আপনার রাজভান্ডার থেকে মূল্যবান আসবাবপত্র চুরি করে উক্ত আলামরিতে রেখেছে এবং তা সকাল সন্ধ্যা দেখতে থাকে। 

বাদশাহ তৎক্ষনাত আইয়াযকে ডাকালেন এবং সকলের সামনে জিজ্ঞেস করলেন যে,

বাদশাহ- আইয়ায তোমার কি কোন আলামরি আছে?

আইয়ায বলল-জি,

বাদশাহ- তাতে তালা লাগিয়ে রাখো?

আইয়ায-জি,

বাদশাহ-সকাল সন্ধ্যা খুলে খুলে দেখো?

আইয়ায-জি,

বাদশাহ- দাও, চাবি দাও সে আলমারির,

আইয়ায-চাবি বের করে দিল।

বাদশাহ এক ব্যক্তিকে পাঠিয়ে বললেন যে, যাও তার আলমারিতে যা কিছু আছে সব এখানে নিয়ে আস। সে ব্যক্তি যখন আলমারি খুলতে গেল আইয়ায চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু সে সমালোচক বড্ড খুশি হয়ে গেল এ ভেবে যে, আজকে ধরা পড়ে যাবে বাদশাহ্‌র কাছে এবং বাদশাহ আজকে বুঝতে পারবে যে, এ ব্যক্তি কতটা খেয়ানতকারী ব্যক্তি। 

যে ব্যক্তি আলমারি থেকে আসবাবপত্র আনতে গেল আলামরি খুলে দেখে যে, আলামরিতে এক জোড়া পুরানো কাপড় এবং এক জোড়া পুরানো জুতো, এ দেখে সে তো আশ্চর্য হয়ে গেল যে, এসব সে সকাল-সন্ধ্যা দেখতে থাকে। অতঃপর সে এ জোড়া দু’টি বাদশাহ্‌র কাছে নিয়ে এলো এবং বাদশাহ্‌কে বলল যে, বাদশাহ সাহেব! তার আলমারিতে এ দু’জোড়া ছিল যা আমি নিয়ে এসেছি।

বাদশাহ বললেনঃ আইয়ায শুধু এ দু’জোড়াই ছিল?

আইয়ায- জি বাদশাহ সাহেব এ দু’জোড়াই ছিল।

বাদশাহ-আইয়ায এসব তো এতটা মূল্যবান নয় যে, তুমি এগুলোকে আলামরিতে বন্ধ করে রেখেছো এবং সকাল-সন্ধ্যা খুলে খুলে দেখতে থাক।

আইয়ায- বাদশাহ সাহেব এগুলো আমার জন্যে অতিমূল্যবান।

বাদশাহ-কেন?

আইয়ায-বাদশাহ সাহেব! আমি যখন আপনার এ শাহী দরবারে প্রথম দিন আসি সে দিন আমি একজন গ্রাম্য লোক হিসেবে এ জোড়াগুলোই পড়নে ছিল, যা আমি সংরক্ষন করে রেখেছি। এখন আমি প্রতি দিন আলমারির দরজা খুলে নিজের মনকে উদ্দেশ্য করে বলি যে-

হে আইয়ায! বাদশাহ্‌র এ দয়ার কথা ভুলে যেও না যে, সে তোমাকে কতটা সম্মান দিয়েছেন, না হয় তোমার সম্মানই বা কি ছিল। এ কথা আমি নিজেকে সকালেও স্মরণ করিয়ে দেই, সন্ধ্যায়ও স্মরণ করিয়ে দেই। 

মাওলানা রূমী বলেনঃ
“যদি এ ধরনের গুণ আল্লাহ আমাদেরকেও দান করতেন যে, আমরাও আমাদের অতীতের কথা স্মরণ করতাম। আমরা কি ছিলাম কি হয়েছি, কোথায় ছিলাম কোথায় এসেছি যে, ধন-দৌলত, নিয়ামত,বরকত ইত্যাদি দিয়ে কি ভাবে আমদেরকে ভরপুর করে দিয়েছেন। আমরাও যদি আমাদের শুরুর কথা স্মরণ করতাম”

যদি দুনিয়ার একজন সাধারণ গোলাম বা চাকর নিজ মালিককে এ ভাবে সম্মান করে থাকে। তাহলে আমরা তো এমনিতেই আল্লাহ্‌র ছোট থেকে ছোট গোলাম, প্রকৃত অর্থে সে-ই আমাদের মালিক, আমরা তারই সৃষ্ট।

অতএব, আমাদের দায়িত্ব যে, আল্লাহ তা‘আলার হুকম-আহকামের সম্মানকে সামনে রেখে সার্বক্ষনিক খেয়াল রাখতে হবে যে, কখনো যেন আল্লাহ তা‘আলার হুকুম-আহকাম আমাদের দ্বারা ভেঙ্গে না যায়। অর্থাৎ তার হুকুমের অমান্যতা যেন না হয়। 

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ থেকে সঠিক শিক্ষা নিয়ে আমল করার তাউফীক্ব দান করুন। আমীন

0 comments:

Post a Comment